কুমায়ুনের অপার নিসর্গ ও পঞ্চচুল্লি দর্শন

হিমালয়ের যে অংশটি সবচেয়ে অপরূপ বলে আমার মনে হয় সেটা হল কুমায়ুন। শান্ত, নির্জন কিন্তু ভয়ানক সুন্দর কিছু জনপদ আছে এই পথে। যা একবার দেখলে মন ভরে না। উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপার। তাই আমাদের গন্তব্য এবার কুমায়ুন। সাতদিনের ছিমছাম ট্যুর। নৈনিতাল থেকে আলমোড়া, কৌশানি, রানিখেত হয়ে পাতাল ভুবনেশ্বর হয়ে মুন্সিয়ারি। হাওড়া থেকে সরাসরি কাঠগোদাম বা লালকুঁয়া পৌছে গাড়িতেই দেখে নেওয়া যায় এই গন্তব্যগুলি। ফেরার পথে এই স্টেশন থেকেই হাওড়ার ট্রেন। সরাসরি ট্রেন না পেলে দিল্লি হয়েও যেতে পারেন। দিল্লি থেকে অনেকগুলি ট্রেন আছে।


রাতের নৈনি লেক…

নৈনিতাল-
কুমায়ুন হিমালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈলশহর হল নৈনিতাল। এখানে সারাবছরই পর্যটকদের ভিড় গিজগিজ করে। কারণ আবহাওয়া চমকপ্রদ, সারা বছরই কমবেশি ঠান্ডা থাকে। কাঠগোদাম অথবা লালকুঁয়া থেকে নৈনিতালের দূরত্ব যথাক্রমে ৩৬ কিমি ও ৬১ কিমি। দুই জায়গা থেকেই বহু গাড়ি পেয়ে যাবেন। সময় লাগবে দুই থেকে চারঘন্টার মতো। প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতায় নৈনিতাল। এখানকার প্রধান আকর্ষন পাহাড়ে ঘেরা নৈনি লেক। ন্যাসপাতির আকারের লেকটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৩৭২ মিটার ও প্রস্থে ৪৫৭ মিটার। শুধুমাত্র একটি হৃদ বা লেক ঘিরে যে একটা জনপ্রিয় পর্যটন শহর গড়ে উঠতে পারে নৈনিতাল না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। লেকের ধারেই রয়েছে নয়নাদেবীর মন্দির। কথিত আছে সতীর বাঁ চোখ পড়েছিল এখানে। সেখানেই গড়ে উঠেছে নয়নাদেবীর মন্দির।


নয়নাদেবীর মন্দির, নৈনিতাল

লেকের নামও নয়নাদেবীর নাম থেকে। এখান থেকেই কেবল কার বা রোপওয়ে চেপে আড়াই কিমি দূরের স্নো-ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়। রোপওয়ে থেকেই দেখা যায় নৈনি লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য। স্নো-ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যায় নন্দাদেবী (৭৮১৬ মিটার) সহ বিভিন্ন বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ। এখানেই রয়েছে ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম চিড়িয়াখানা। এখানে দেখা মিলবে রেড পাণ্ডা সহ বহু বিরল পশুপাখি। এবার আসি নৈনি লেকের কথায়। বিশাল এই পান্না সবুজ লেকের জলে ইতিউতি ঘুরে বেড়ায় রাজহাঁস। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য বোট বা নৌকা। যন্ত্রচালিত হোক বা হাতে টানা সব ধরণেরই নৌকা রয়েছে এই লেকে জলবিহারের জন্য। এছাড়া পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্ত হোক বা ভোরের রাঙা সূর্যদয়, লেকের জলে বরফাবৃত পাহাড় চূড়ার প্রতিচ্ছবি দেখেই দিন কেটে যাবে আপনার। কেনাকাটা করার সেরা জায়গা নৈনিতাল। শীতবস্ত্র থেকে ঘর সাজানোর নানান টুকিটাকি জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। বিশেষ করে নৈনিতালের মোমের তৈরি নানান সামগ্রী জগৎ বিখ্যাত। এখানেই দুটি দিন কাটিয়ে নিতে পারেন।


নৈনি লেক, নৈনিতাল

কৌশানি-

এবারের গন্তব্য কৌশানি। নৈনিতাল থেকে গাড়িতেই নয়নাভিরাম পাহাড়ি রাস্তায় পাইন-চির গাছের ছায়ায় ঢাকা পথ গিয়েছে কৌশানির দিকে। নৈনিতাল থেকে এর দূরত্ব ১০০ কিমি। গাড়িতে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টা মতো। কৌশানি জায়গাটা ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তাই এখানে বাঙালি টুরিস্টই বেশি আসেন। গান্ধিজি ১৯২৯ সালে কৌশনিতে এসে ছিলেন দুই সপ্তাহ। এই জায়গার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি কৌশনিকে, ‘Switzerland of India’ বলেছিলেন। এখানের অন্যতম দ্রষ্টব্য হল গান্ধি আশ্রম। শান্ত পরিবেশে এই আশ্রমে রয়েছে সংগ্রহশালা। কৌশানি মানেই শুধু পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে সাজানো পাইন গাছের আড়ালে বা ব্যালকনি থেকে পাহাড়চূড়া। যা দেখেই বেশ কয়েক দিন কেটে যায়।


কৌশানি থেকে হিমালয় দর্শন ও চা বাগান

কৌশানি থেকে মাত্র ১৭ কিমি দূরে গোমতী নদীর তীরে বৈজনাথ মন্দির। ৯ম থেকে ১২য় শতাব্দীর মধ্যে কোন এক সময়ে নির্মিত হয়েছিল এই মন্দিরটি। মন্দির প্রাঙ্গনে প্রায় ১২-১৩টি ছোট বড় মন্দির রয়েছে। মূল মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিব। এছাড়াও এখানে রয়েছেন পার্বতী, গণেশ সহ অন্যান্য হিন্দু দেবদেবী। এর পাশেই রয়েছে বিশাল ঝিল বা জলাধার। গোমতি নদীতে বাঁধ দিয়ে এটি তৈরি। ফলে পাহাড়ের মাঝে এই ঝিল এক অবশ্য দ্রষ্টব্য। কৌশানির আরেকটি বৈশিষ্ট রয়েছে। এখান থেকেই দেখা যায় হিমালয়ের ৯টি সুউচ্চ শৃঙ্গ। এরমধ্যে চৌখাম্বা, ত্রিশূল, নন্দাঘুনটি, নন্দাকোট, পঞ্চচুল্লি অন্যতম। ফলে সামনের উন্মুক্ত পরিবেশে হিমালয়ের সৌন্দর্য দেখেই সময় কেটে যাবে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে রয়েছে বেশ কয়েকটি চা-বাগান। কৌশানির শাল ফ্যাক্টারিও বেশ বিখ্যাত। পাশাপাশি এখানে রয়েছে আপেল, ন্যাসপাতি ও আলমন্ডের চাষ।


আলমোরা

আলমোরা-
উত্তরাখণ্ডের আরেক জনপ্রিয় শৈলশহর হল আলমোরা। যাকে কুমায়ুনের সংস্কৃতির রাজধানী বলা হয়। কুমায়ুনের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভর করেই ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ করেছে আলমোরা। এই শৈল শহরের উচ্চতা ১৬৫০ মিটারের মতো। অশ্বখুরাকৃতি গিরিশিরায় আলমোরা শহর গড়ে উঠেছে। হিমালয়ের অপরূপ নৈসর্গ ছাড়াও আলমোরা শহরকে কেন্দ্র করে দেখার মতো বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম গোলু দেবতার মন্দির। যা শহর থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট হল হাজার হাজার ঘন্টা ঝোলানো থাকে। আপনিও ইচ্ছা থাকলে এই মন্দিরে ঘন্টা ঝুলিয়ে আসতে পারেন। ফার ও পাইনে ঘেরা পাহাড়ের কোলে এই মন্দিরটি অপরূপ সুন্দর। এছাড়া রয়েছে প্রায় হাজার বছরের পুরোনো নন্দাদেবীর মন্দির। পাশাপাশি ঐতিহাসিক দিক থেকে রয়েছে প্রাকৃতিক গুহা। যা আলমোরা থেকে ২০ কিমি দূরে লাখুদিয়ার অগুন্তি গুহা নামে পরিচিত। এখানে প্রাগঐতিহাসিক গুহাচিত্র রয়েছে। আলমোরার সানরাইজ ও সানসেট পয়েন্ট থেকে হিমালয়ের সুউচ্চ বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গে সূর্যের আলোর খেলা দেখাও এক বিরল স্মৃতি হয়ে থাকবে মনের মনিকোঠায়।



মুন্সিয়ারি-
উত্তরাখণ্ডের প্রত্যন্ত জেলা পিথোরাগড়ের এক ছোট্ট জনপথ মুন্সিয়ারি। কিন্তু এই শহরই উত্তরাখণ্ডের অন্যতম বড় পর্যটন কেন্দ্র। যাকে পর্যটকরা কুমায়ুনের কাশ্মীর বা ছোট কাশ্মীর বলে ডেকে থাকেন। ২২০০ মিটার উচ্চতায় শহরটি এতই ছোট যে শুরু হয়েই যেন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মুন্সিয়ারির যেখান সেখান থেকেই দেখা যায় পঞ্চচুল্লি সহ কয়েকটি পর্বত শিখর। পঞ্চচুল্লি যেন আপনার হাতের নাগালে। আর যদি ভরা পূর্ণিমায় মুন্সিয়ারি যেতে পারেন, তবে তো সোনায় সোহাগা। চাঁদের আলোয় পঞ্চচুল্লি দর্শন জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে আজীবন। আজও মুন্সিয়ারিতে হোটেলের বাড়াবাড়ি কম, তাই আগেভাগে বুকিং করে রাখতে হয়। আর হোটেল-বাজার কম বলেই মুন্সিয়ারির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজও অমলীন। নন্দাদেবির জোড়া শিখর, নন্দঘুঁটি, ত্রিশুল, গৌরি পর্বত, হাতি পর্বত, নীলকান্ত, কামেট প্রভৃতি শিখররাজি সুন্দর দৃশ্যমান মুন্সিয়ারি থেকে।



মুন্সিয়ারি থেকে পঞ্চচুল্লি
এখান থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেকিং পথ রয়েছে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝপর্ব পর্যন্ত এই জনপদ বরফে ঢাকা থাকে। সেটাও পর্যটকদের কাছে আকর্ষক। ফলে শীতের মুন্সিয়ারি আরও অপরূপ। আর পড়ন্ত বিকেলে সাক্ষী হতে পারেন এক অপার্থিব সূর্যাস্তের। পৌরানিক দিক থেকেও মুন্সিয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। কথিত আছে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব স্বর্গযাত্রা শুরু করেছিলেন এই মুন্সিয়ারি থেকেই। আর পঞ্চচুল্লির যে পাঁচটি শিখর দেখা যায়, সেগুলি আসলে দেখতে চুল্লি বা উনুনের মতো। কথিত আছে এই পাঁচটি উনুনের উপরই রান্না চাপিয়েছিলেন দ্রৌপদী। রান্না করে খাইয়েছিলেন পাঁচ স্বামীকে। ২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে নন্দাদেবীর মন্দির ও হিমালয় দর্শনের ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকেই পঞ্চচুল্লির সবচেয়ে সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। এই মন্দির মুন্সিয়ারি থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে। এখান থেকে পঞ্চচুল্লিতে সূর্যাস্তের রংবদলের দৃশ্য আজীবন মনে থাকবে। এছাড়া রয়েছে ১২ কিমি দূরে আদিবাসী গ্রাম দারকোট এবং ২২ কিমি দূরে গৌরীগঙ্গার পাশে একটি উষ্ণ প্রস্রবন।


পঞ্চচুল্লিতে সূর্যাস্ত
রানিখেত-

রানিখেতকে কুমায়ুনের রানি বলেও ভুল করা হয় না। ওক, পাইন, ফারের জঙ্গলে ঘেরা শান্ত-শীতল পরিবেশের রানিখেত ইংরেজ আমলের তৈরি এক অপরূপ শৈলশহর। মার্চ থেকে জুন আবার সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলে এখানকার পর্যটন মরশুম। তবে শীতের রানিক্ষেত আরও সুন্দর। পুরো শহরটি পুরু বরফে মোড়া থাকে। কাঠগোদাম থেকে এর দূরত্ব ৮৫ কিমি। শহরের মাঝেই রয়েছে আশিয়ানা পার্ক। বিভিন্ন পাহাড়ি ফুলের সমাহার দেখা যায় এখানে। আরেক দ্রষ্টব্য হল গল্ফ কোর্স। এটি এশিয়ার উচ্চতম গস্ফ কোর্স। কাছেই রয়েছে মনকামেশ্বর মন্দির। ঝরনার ধারে প্রাচীন শিবের বিরাট মূর্তি শোভা পাচ্ছে এখানে৷ এছাড়া রয়েছে আপেন বাগান। হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আসতেই হবে রানিখেত। এখান থেকেই কাঠগোদাম বা লালকুঁয়া পৌঁছে দিল্লি বা হাওড়ার ট্রেন ধরতে পারেন।


বরফে ঢাকা রানিক্ষেত

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post