পুরাণ থেকে কল্প বিজ্ঞান, যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্পনায় স্থান পেয়েছে রহস্যময় পাতাল। এককথায়, ভূগর্ভের ভিতর কি আছে সেটা জানার কৌতূহল। পৌরাণিক কাহিনীতে রাবণের পিতা মহীরাবণ পাতালের অধীশ্বর ছিলেন। আবার মৃত্যুর দেবতা যমরাজও পাতালের অধীশ্বর। একইভাবে গ্রিক কাহিনীতে হেডস পাতালের দেবতা হিসেবে পরিচিত। ফলে পাতালের প্রতি মানুষের কৌতূহল সেই আদিকাল থেকেই। এই সূত্র ধরেই একটি অমোঘ প্রশ্ন সামনে চলে আসে, পাতালে প্রবেশের জন্য কোনও দ্বার বা দরজা আছে কিনা?
গুহার প্রবেশদ্বার
এর উত্তর জানতে আপনাকে যেতে হবে উত্তরাখণ্ডে। হিমালয়ের কোলে এই রাজ্যের
পিথোরাগড় জেলা। এই জেলাতেই গঙ্গোলিহাট বলে একটা ছোট্ট শান্ত জনপথ রয়েছে,
তারই ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাতাল ভুবনেশ্বর মন্দির। নামেই মন্দির,
আসলে এই একটি প্রাকৃতিক গুহা। সরু গুহামুখ দিয়ে কার্যত হামাগুড়ি দিয়ে
টেনে-হিঁচড়ে পাতালে অর্থাৎ মাটির নীচে নামতে হবে। প্রবেশদ্বার থেকে প্রায়
৯০ মিটার নীচে রয়েছে এক অত্যাশ্চর্য গুহামন্দির। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০
মিটার। এটাই পাতাল ভুবনেশ্বর নামে পরিচিত, যাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য
কিংবদন্তি।
এই সংকীর্ণ সুরঙ্গপথেই নামতে হবে মাটির ৯০ মিটার নীচে
প্রাচীন কয়েকটি পুরাণে এই গুহার বর্ণনা রয়েছে। স্কন্ধপুরাণে বর্ণিত আছে,
রাজা নলকে লুকিয়ে রাখার সময় সূর্যবংশীয় রাজা ঋতুপর্ণ এই গুহা খুঁজে পান।
এখানেই তিনি শেষনাগের দেখা পান, এবং শেষনাগই তাঁকে এই গুহার ভিতর নিয়ে
যায়। নিচে অর্থাৎ পাতালে গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণ বহু দেবদেবীর মূর্তি দেখেন।
কিন্তু সেই থেকে এই গুহার দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। কলিযুগে এই গুহা ফের
আবিষ্কার করেন আদিগুরু শঙ্করাচার্য। কিংবদন্তি অনুযায়ী স্বয়ং মহাদেব
সত্যযুগে এই গুহা তৈরি করেছিলেন। তবে এই গুহায় প্রবেশ করা যে সত্যিই
পাতালে প্রবেশ করার সমান, সেটা যে গিয়েছেন তিনিই হাড়ে হাড়ে টের
পেয়েছেন। গুহার প্রবেশপথের বাইরেই সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে লেখা, ‘দুর্বল
হৃদয়ের ব্যক্তিদের গুহার ভিতরে প্রবেশ নিষেধ’।
কিংবদন্তি এটিই শেষনাগ
কাঠগোদাম বা হলদোয়ানি থেকে যারা
গঙ্গোলিহাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন, তাদের জন্য তিনটি বিকল্প পথ আছে।
রামগড়-মুক্তেশ্বর হয়ে একটি রাস্তা, ধানাচুলি-নাটাডল হয়ে একটি রাস্তা,
ভীমতাল-আলমোড়া-বেরিনাগ হয়ে একটি রাস্তা। প্রতিটি পথই অতুলনীয়
সৌন্দর্য্যে ভরা। আবার কৌশানী থেকে আলমোড়া-রানিক্ষেত হয়েও পৌঁছে যাওয়া
যায় পাতাল ভুবনেশ্বর। উল্লেখ্য হাওড়া থেকে সরাসরি কাঠগোদাম যাওয়ার জন্য
একটি ট্রেন আছে। এছাড়া হাওড়া থেকে সপ্তাহে একদিন ছাড়ে লালকুঁয়া
এক্সপ্রেস। সেটিও কাঠগোদামের দুটি স্টেশন আগে পর্যন্ত যায়। কাঠগোদাম,
হলদোয়ানি বা লালকুঁয়া থেকে গাড়িতে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যায় পাতাল
ভুবনেশ্বর।
নামে কি এসে যায়? গঙ্গোলিহাট…
অতীতের কোনও এক সময়, এই বাংলাদেশের কোনও এক গাঙ্গুলিমশাই এই অঞ্চলে এসে হাট স্থাপন করেন, তিনি একটি কালিমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারই নাম অনুযায়ী, এই এলাকার নাম গঙ্গোলিহাট। আবার স্থানীয় লোকগাথা অনুযায়ী, সরযূ ও রামগঙ্গা এই এলাকায় মালার (স্থানীয় ভাষায় ‘আওয়ালি’) মতো শোভা পায় বলে এই এলাকার নাম হয়েছে গঙ্গোলিহাট (গঙ্গা+আওয়ালি)। শহরের কেন্দ্রেই ‘হাটকালি’ মাতার মন্দির। তবে নামে কি এসে যায়? এই শহরের আশেপাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি গুহামন্দির। যেমন, শৈলেশ্বর, মুক্তেশ্বর, ভোলেশ্বর এবং পাতালভুবনেশ্বর। সর্বশেষ মন্দিরটি নিয়েই আজ আমার গল্প।
পঞ্চচুল্লি শিখর সমুহ…
পাতাল ভুবনেশ্বরঅষ্টম শতাব্দীতে আদিগুরু শঙ্করাচার্য এই গুহাটি আবিষ্কার করেন। প্রাকৃতিক-রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপের এক শৈল্পিক প্রকাশ এই পাতাল ভুবনেশ্বর। গুহার প্রবেশপথটি বড়জোর এক থেকে দেড় মিটার চওড়া। ফলে উল্টো মুখে, প্রথমে শরীরের নিম্নাংশ ভিতরে ঢুকিয়ে পাতাল প্রবেশ শুরু করতে হয়। এরপর শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে নীচের দিকে নামা। গাইড ছাড়া এখানে প্রবেশ করা অসম্ভব। একজনের ঘাড়ের ওপর আরেকজন। মুহুর্মুহু ‘জয় পাতাল ভুবনেশ্বরের জয়’ ধ্বনিত কেঁপে উঠছে পাতাল পথ। দুপাশে লোহার রড ও শিকল ধরে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে পথেই নীচে নামা। প্রায় মাতৃগর্ভের প্রসবনালীর ভেতর দিয়ে দ্বিতীয়বার ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো। কথিত আছে এটিই অনন্তনাগের পিঠ। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী শেষনাগের পেটই হল এই পাতাল ভুবনেশ্বর গুহা। ফলে সেই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে প্রায় চল্লিশ ধাপ সিঁড়ি (নামেই সিঁড়ি, আসলে ভয়ংকর এবড়োখেবড়ো পাথরখন্ড) বেয়ে নেমে খানিকটা খোলামেলা জায়গা। খোলামেলা মানে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় আর কি। ভূমিতল থেকে প্রায় ৩০ মিটার নীচে। এরই চারপাশে আলো-আঁধারে নানান রহস্যময় হাতছানি।
রহস্যই বটে, তেত্রিশ কোটি দেবতাই যেন ঠাঁই নিয়েছেন এই পাতালে। কত যুগ-যুগান্ত ধরে চুনাপাথরের গুহায় জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে বালি, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হওয়া এক একটি অপার ঐশ্বর্য্যের স্থাপত্য গড়ে উঠেছে প্রকৃতির আপন খেয়ালে। ভূ-রাসায়নিক স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাকটাইটের মধ্যে মিশে থাকা পৌরাণিক গল্পগাথা। গণেশের মাথা কাটা যাওয়ার কাহিনি, সমুদ্রমন্থনের কাহিনি, পবননন্দনের পাতাল অভিযানের কাহিনি। গুহায় ঢুকেই দেখতে পাবেন মহা জটাজুটধারী মহাদেবের মূর্তি প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। তারই নীচে অসংখ্য শিবলিঙ্গ। ওপর থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে দুধ। সে কোন অনন্তকাল থেকেই এই প্রক্রিয়া হয়ে চলেছে। গুহার ভিতরে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পৌরাণিক মূর্তি। যা প্রকৃতির আপন খেয়ালই সৃষ্টি হয়েছে। তবে গুহার নীচে অক্সিজেনের অভাব থাকে। তাই বেশিক্ষণ থাকলে শ্বাসকষ্ট হয়। তাই চক্ষু সার্থক করে একইপথে উপরে উঠে আসা। শান্ত ও স্নিগ্ধ হিমালয়ের অনুভূতি পেতে হলে একরাত থাকতেই পারেন পাতাল ভুবনেশ্বরে। এখান থেকেও পঞ্চচুল্লি শিখরের দর্শন মেলে।
Post a Comment
Thank You for your important feedback