রেশমপথের ভুলভুলাইয়া ‘জুলুক’

রেশমপথ, নামের রয়েছে ইতিহাসের সোঁদা গন্ধ। প্রাচীনকালেই এই পথ ধরে তিব্বত-চিন থেকে ভারতে বাণিজ্য করতে আসতেন ব্যবসায়ীরা। ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষার টানে ছুটে আসতেন পরিব্রাজক ও শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীকালে এই পথই তিব্বত-চিন ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল সুদূর মিশর পর্যন্ত। তখন সীমান্তের কাঁটাতার যেমন ছিলনা, তেমনই ছিলনা আধুনিক শীতবস্ত্র ও যন্ত্রপাতি। ফলে পায়ে হেঁটে চামরি গাইয়ের পিঠে বাণিজ্যদ্রব্য চাপিয়ে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা চলতো। বিপদসঙ্কুল এই পথেই চিনের রেশম ভারতে এনে বিক্রি করতেন ব্যবসায়ীরা। পারস্য থেকে আসতো কার্পেট। বিনিময়ে ভারত থেকে তাঁরা নিয়ে যেতেন মশলাপাতি ও অন্যান্য দ্রব্য।
জুলুকের পথে
ফলে কালক্রমে এই পথই পরিচিত হয়েছে রেশমপথ বা সিল্ক রুট নামে। এই প্রাচীন বাণিজ্যিক পথই খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এশিয়ার উপমহাদেশীয় অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে। ৬৫০০ কিমি বিস্তৃর্ণ এই পথের একটা নস্টালজিক ছোঁয়া পাওয়া যাবে ভারতের এক ছোট্ট প্রত্যন্ত প্রদেশ সিকিমে গেলেই। প্রাচীন রেশমপথের পাথুরে রাস্তায় হাঁটলে অবশ্যই পাবেন ইতিহাসের সেই সোঁদা গন্ধ। পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং থেকে সিকিমের পেডং-লিংতাম-জুলুক-কুপুপ হয়ে তিব্বতে প্রবেশ করেছে রেশম পথ। তবে রেশমপথের প্রবেশদ্বার হল লিংতাম। আমাদের যাত্রা শুরু হল আরিতার থেকে। সিকিমের ছোট্ট জনপথ এই আরিতার। এখানেই জঙ্গলের মধ্যেদিয়ে প্রাচীন রেশমপথের কিছু অংশ রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে। পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখা যায়।

আরিতার-

এনজেপি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ১১৫ কিমি দূরে আরিতার। এখানেই প্রাকৃতির মাঝে নির্জনে একরাত কাটিয়ে ট্রেন জার্নির ক্লেশ কাটিয়ে নিয়ে শরীরটা ঝড়ঝড়ে করে নেওয়া গেল। প্রসঙ্গত, সিল্ক রুটের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে হলে আগাম অনুমতি নিতে হয়। আরিতারের কাছেই রংলি বলে এক জনপদ থেকেই পাওয়া যাবে যাবতীয় অনুমতি পত্র। স্থানীয় এসডিও অফিসে সচিত্র পরিচয় পত্র (ভোটার বা আধার কার্ড বা পাসপোর্ট) এবং দুকপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিতে হয় অনুমতি আদায়ের জন্য। স্থানীয় গাইড বা গাড়ি চালকেরাই এই অনুমতিপত্র জোগার করে দেবেন। এবার আসি আরিতারের কথায়। পাহাড়ের কোলে শান্ত-নির্জন ছোট্ট জনপথ আরিতার।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ১১৫ কিমি উজিয়ে বিকেল বিকেল আরিতার পৌঁছে রাত্রিবাস। সন্ধ্যা নামতেই গাঢ় অন্ধকার চারিদিক। বেস কয়েকটি হোম-স্টে রয়েছে আরিতারে। তাই ঘরের আতিথেয়তায় সন্ধ্যেই হাজির গরম চা ও ফ্রায়েড মোমো সহযোগে ঠান্ডার সঙ্গে দোস্তি করা। যাকে বলে প্রবল ঠান্ডার সঙ্গে লড়াইয়ের ওয়ার্ম-আপ। পরদিন যাবে জুলুক। পরদিন খুব ভোরে উঠে দেখে নিলাম হিলটপ পয়েন্ট। সেখান থেকে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মন সার্থক করলাম। হোম-স্টে ফিরে ব্রেকফাস্ট করে ফের সেঁধিয়ে গেলাম গাড়িতে। পথে দেখে নিলাম আরিতার লেক ও আরিতার গুম্ফা। পান্না সবুজ আরিতার লেকে নৌকা বিহারের ব্যবস্থাও রয়েছে। রংলি থেকে সিল্ক রুটে প্রবেশের অনুমতিপত্র নিয়ে রওনা দিলাম জুলুকের পথে।
ওল্ড বাবা মন্দির
জুলুক-

সমতল থেকে প্রায় ১১ হাজার ফুট উপরে অবস্থান জুলুকের। নাথাং ভ্যালিও প্রায় একই উচ্চতায়। ফলে ঠান্ডা এই এলাকায় প্রবল। তাই এই পথে যেতে হলে ভারী শীতের পোশাক সঙ্গে রাখুন। জুলুকের মূল দ্রষ্টব্য অবশ্যই পাহাড়ের কোলে অসাধারণ ‘জিগজ্যাগ’ রাস্তাটি। একসঙ্গে পরপর ২২টি হেয়ারপিন বেন্ডের বাঁক নিয়ে এঁকেবেঁকে অজগর সাপের মতো উপরে উঠেছে সিল্ক রুটের এই প্রধান রাস্তা। অসাধারণ সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। যাইহোক লিমথাং হয়ে জুলুক যাওয়ার রাস্তাটিও অতি সুন্দর। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ জুলুক। গোটা গ্রামে ১০০টির কাছাকাছি পরিবারের বাস জুলুকে। শীতের অধিকাংশ সময় পুরু বরফের তলায় ঢাকা থাকে এই অঞ্চল। তবে চিনের সীমান্তবর্তী হওয়ায় সারা বছরই রাস্তা চালু রাখে সেনা বাহিনী। জুলুকও আসলে সেনাছাউনি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে জুলুকের দূরত্ব ১৫০ কিমি মতো। সিকিমের পর্যটন বিভাগের সৌজন্যে এখানে পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি হোম-স্টে। নেই সেরকম ভালো হোটেল। তবে হোম-স্টে গুলি যথেষ্ঠ ভালো ও অতিথিপরায়ন।
জিগজ্যাগ রোড, জুলুক
দর্শনীয় স্থান-

আগেই বলেছি, জুলুকের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম জিগজ্যাগ রোড। তবে কপাল ভালো থাকলেই পুরো ভিউ পাবেন, কারণ আবহাওয়া যখন তখন খারাপ হয় এখানে। ফলে মেঘের আড়ালেই চলে যায় এই রাস্তার ভিউ। জুলুকের বেশিরভাগ জায়গা থেকেই দেখতে পাওয়া যায় এই অসাধারণ ভিউ। জুলুক থেকে ১৩ কিমি উপরে রয়েছে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। উচ্চতা ১১,২০০ ফুট। এখান থেকেই মূলত জিগজ্যাগ রোডের পুরো ভিউ দেখা যায়। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথটি ৯৫টি বাঁক (Hair pin Bend) নিয়ে যেন মনে হবে বিশাল এক অজগরের মতো পাহাড়টিকে জড়িয়ে রয়েছে। থাম্বি থেকে কিছুটা উপরে উঠলেই সুংথুং সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট। এর উচ্চতা ১১,৬০০ ফুট।
থাম্বি ভিউ পয়েন্ট থেকে
এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাবেন। আর ভোরে সূর্যের আলোর প্রথম পরশ যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে পড়ে তখন নতুন বউয়ের মতো রাঙা বদনে সেজে ওঠে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গটি। এরপরের গন্তব্য ওল্ড বাবা মন্দির। বাবা মন্দিরের গল্প অনেকেই জানেন। গ্যাংটকের কাছাকাছি নতুন বাবা মন্দির তৈরি হয়েছে। কিন্তু রেশমপথে রয়েছে পুরোনো বাবা মন্দিরটি। পাহাড়ের অনেকটা উপরে এই মন্দিরের সামনেই গাড়ি চলে যায়। কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই প্রবল ঠান্ডা হাওয়া আপনাকে স্বাগত জানাবেই। ফিরতি পথে নাথাং ভ্যালি দেখে জুলুক ফিরে আসুন।
নাথাং ভ্যালি
অথবা পুরোনো বাবা মন্দির থেকে সোজা গ্যাংটক চলে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে গ্যাংটকে থেকে ছাঙ্গু লেক, নাথু-লা দেখে সমতলে ফিরে আসতে পারেন। এবার আসি নাথাং ভ্যালির কথায়। নাথাং ভ্যালি মানেই বরফের সাম্রাজ্য। শীতকালে এই অঞ্চল প্রায় ৫ ফুট বরফের তলায় থাকে। নাথাংয়ের উচ্চতা সাড়ে ১৩ হাজার ফুট। এখানেও থাকার জন্য কয়েকটি হোম-স্টে রয়েছে। বরফের সাম্রাজ্যে এসে আপনি অবশ্যই হারিয়ে যাবেন ছোটবেলায়। তবে প্রবল শীতের কথা মাথায় রাখতে হবে।

কিভাবে যাবেন-

এনজেপি থেকে জুলুকের দূরত্ব ১৫০ কিমি। এনজেপি থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসুন এই পথে। পুরো পথের জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিলে খরচ যেমন একটু কম হবে, তেমনই পথে অনেক বেশি জায়গা ঘুরে দেখতে পারবেন। হাওড়া ও শিয়ালদা থেকে প্রচুর ট্রেন যায় এনজেপি। নাথুলা ও জুলুকের পথে যেতে হলে সিকিমের পর্যটন ও অসামরিক দফতরের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। তারজন্য চাই ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্টের মতো সচিত্র পরিচয় পত্র। দু কপি পাসপোর্ট ছবি।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post