‘তিন সাগরের রানি’ স্বামীজীর কন্যাকুমারী

দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের দিকে পিছন ফিরে উত্তর পানে চাইলে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগবে। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন গোটা ভূ ভারতের পাদদেশে। শ্রদ্ধায় ও আবেগে মন ভরে উঠতে বাধ্য। হ্যাঁ আমি কন্যাকুমারীর কথা বলছি। তিন সাগরের রানি হল কন্যাকুমারী। সাগরপারে দাঁড়ালেই সামনে শান্ত ঘন নীল ভারত মহাসাগর, একটু বাঁ দিকে ফিকে ও ঘোলাটে নীলের বঙ্গোপসাগর ও ডান দিকে পান্না সবুজ আরব সাগর। দূরে হালকা জল বিভিজিকাও দেখা যায় কন্যাকুমারীর ঘাট থেকে।
বিবেকানন্দ রক ও তিরুভাল্লুভারের বিশাল মূর্তি
বোল্ডারের আধিক্য থাকায় এখানে সমুদ্রস্নান সম্ভব নয়, বেশ বিপদজ্জনক। কিন্তু ভারতের একমাত্র সৈকত, যেখানে এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রে সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পাবেন। বাঙালির অতি গর্বের শহর কন্যাকুমারী। এখানেই স্বামী বিবেকানন্দ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তিন সমুদ্রের মাঝে ওই শিলাই আজ বিবেকানন্দ রক নামে খ্যাত। আর আছে কুমারী মাতার মন্দির। সতীর অন্যতম পীঠস্থান। সবমিলিয়ে পর্যটকদের কাছে স্বর্গরাজ্য হল কন্যাকুমারী। তিন সাগরের মিলনস্থল, তাই সর্বদা উত্তাল সমুদ্র। বড় বড় ঢেউ এদিক-ওদিক থেকে আছড়ে পড়ছে বোল্ডার ঘেরা সৈকতে। দেখে মনে হবে যেন তিন সাগর ভারত মাতার পা ধুঁইয়ে দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কন্যাকুমারীতে সূর্যদয়

কন্যাকুমারী-

তিনটি কারণে কন্যাকুমারীর তাৎপর্য আলাদা। প্রথমত, এটাই ভারতের শেষ বিন্দু বা মূল ভূখণ্ডের শেষ প্রান্ত। দ্বিতীয়ত, তিন সাগরের মিলনস্থল। তৃতীয়ত, স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতি মন্দির। ফলে কন্যাকুমারী না ঘুরলে বাঙালির ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের ত্রিবেণী সঙ্গম। এখানেই কিছুটা দূরে সাগরের বুকে জেগে থাকা এক পাথরের ওপর তৈরি হয়েছে বিবেকানন্দ রক। যা ভারতের মহান আধ্যাত্মিক গুরু স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিবিজরিত মন্দির বা মণ্ডপম। এক পাশে রয়েছে ১৩৩ ফুট উঁচু বিখ্যাত তামিল কবি তিরুভাল্লুভারের বিশাল মূর্তি। দুটোই সমুদ্রের মাঝে। বিবেকানন্দ রকে যেতে হলে চড়ে বসতে হবে ভেসেলে। উত্তাল সমুদ্রের দোলা খেতে খেতে প্রায় ২০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় বিবেকানন্দ রকে।
কন্যাকুমারীতে সূর্যাস্ত
সকাল থেকেই পর্যটক ও শ্রদ্ধালুদের লম্বা লাইন। কারণ ভারতের দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন এই মন্দির দর্শনে। ফলে খুব ভোর থেকেই লাইন শুরু হয়ে যায়। তাই তারাতারি লাইনে দাঁড়াতে হয়। নাহলে কয়েক হাজার লোকের পিছনে পড়ে গেলেই পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাবে। সাধারণ টিকিটের দাম ৫০ টাকা। তবে লাইন এড়িয়ে জলদি যেতে চাইলে কাটবে হবে স্পেশাল টিকিট। তার জন্য গুণতে হবে বাড়তি টাকা। সুবিশাল এই প্রস্তরখণ্ডের উপর ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁরই স্মৃতিতে ১৯৭০ সালে নির্মিত হয়েছে এই মন্দির। এখানে স্বামীজির বিশাল মূর্তি ছাড়াও রয়েছে ধ্যানগৃহ, মেডিটেশন হল, ও বুক স্টোর। এই বিবেকানন্দ রক থেকে কন্যাকুমারী শহরের তটরেখা দেখা যায়। মনোমুগ্ধকর এই দৃশ্য মন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পাশেই রয়েছে তামিল কবি তিরুভাল্লুভারের বিশাল মূর্তিটি। সেখানে অবশ্য সাধারণ পর্যটকদের যাওয়া মানা।
লাইট হাউস, কন্যাকুমারী
দূরে দেখা যায় কন্যাকুমারী শহরের লাইট হাউসটি। বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে যাওয়া। এবার দেখে নেওয়া গেল প্রায় ৩০০০ বছরের প্রাচীন কুমারী আম্মান মন্দির। কুমারী রূপেই এখানে পার্বতীকে পুজো করা হয়। কথিত আছে পার্বতী শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। শিবের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে দেবী কুমারী থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে আজও মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। আর পুরুষদের খালি গায়ে ধুতি পড়েই প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরের আরতি দর্শন খুবই মনোরম। খুব ভোরে তিন সাগরের পারে পৌঁছাতে হয় সূর্যদয় দেখতে হলে।
কুমারী আম্মান মন্দির

সৈকতে তিল ধরানোর জায়গা থাকেনা। বঙ্গোপসাগরের জল থেকে সূয্যিমামা যখন ঝুপ করে দেখা দেয়, তখন মনে হয় সদ্য স্নান সেরে উঠেছেন সূর্যদেব। সূর্যদয় দেখার জন্য সমুদ্রের মধ্যে তিন কিমি পথ বড় বড় বোল্ডার দিয়ে ভিউ পয়েন্ট তৈরি করা হয়েছে। আবার বিকেল বিকেল সৈকতে চলে আসুন সূর্যাস্ত দেখার জন্য। কারণ দারুণ ভিড় হয় সূর্যাস্ত দেখার জন্য। পড়ন্ত বিকেলে সূয্যিমামা ডুব দেন আরব সাগরের জলে। এক মায়াবী পরিবেশের জন্ম হয় সেই সময়। একদিকে কুমারী আম্মান মন্দিরের আরতির বাদ্য ও শঙ্খধ্বনী অন্যদিকে কন্যাকুমারী শহরে একে একে জ্বলে উঠছে মায়াবী আলো।
সুচীন্দ্রম মন্দির
কন্যাকুমারী এলে দুই-তিন দিন কিভাবে কেটে যাবে বুঝতেই পারবেন না। যদিও আশেপাশের বেশ কয়েকটি জায়গা দেখার আছে। ঘুরে নিতে পারেন ভাট্টাকোট্টাই ফোর্ট, দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। সমুদ্রতীরবর্তী এই দুর্গটি নির্মাণ করেন ত্রাভাঙ্কোরের রাজা মার্তণ্ড বর্মা। এরপর দেখে নিন সুচীন্দ্রম মন্দির। এখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের একত্রে একটাই মূর্তি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিন দেবতার আলাদা ভাবে পুজো হয়। কন্যাকুমারী থেকে দূরত্ব ১৩ কিমি। এছাড়া দেখে নিতে পারেন ১৯ কিমি দূরের নাগেরকোয়েল। এখানে রয়েছে সর্প দেবতার মন্দির। শহর থেকে ৪৫ কিমি দূরে রয়েছে পদ্মনাভপুরম। এখানে রয়েছে ত্রিবাঙ্কুর রাজাদের প্রাসাদ। ১৭ শতকের প্রাচীন কারুশিল্প ও চিত্রসম্ভার।
ভাট্টাকোট্টাই ফোর্ট

কিভাবে যাবেন-

হাওড়া থেকে সরাসরি কন্যাকুমারী যাওয়ার একটিই ট্রেন আছে। ১২৬৬৫ হাওড়া-কন্যাকুমারী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। প্রতি শনিবার হাওড়া থেকে ছেড়ে কন্যাকুমারী পৌঁছায় সোমবার। এছাড়া হাওড়া থেকে ছাড়ে ১৩০২৭ নাগেরকোয়েল কবিগুরু এক্সপ্রেস। পাশাপাশি ট্রেনে চেন্নাই, তিরুবন্তপুরম গিয়ে সেখান থেকেও কন্যাকুমারী পৌঁছানো যায়। এছাড়া দক্ষিণ ভারতে বাস পরিষেবা অত্যন্ত ভালো। দক্ষিণের প্রায় সব বড় শহর থেকেই বাস পাবেন কন্যাকুমারীর।
সর্প দেবতার মন্দির, নাগেরকোয়েল

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post