বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বসেই রয়েছেন বাঙালি। প্রতি পুজোয় কু ঝিকঝিক ট্রেনে চেপেই বেশিরভাগ বাঙালি বেড়িয়ে পড়েন আজানাকে জানতে। কয়েকটা দিন পর্যটন করে ফের ফিরে আসেন কর্মব্যস্ত জীবনে। কিন্তু এবছর সত্যিই আলাদা। করোনা কাটায় পর্যটন বিপর্যস্ত। পায়ের তলায় সর্ষে নিয়েও বাঙালি তাই চুপচাপ দিন গুনছিলেন করোনা বিদায়ের। কিন্তু আর কতদিন? তাই এবাররে পুজোয় কাছেপিঠেই ঘুরে আসতে চাইছেন অনেকে। যেখানে লোক সমাগম কম, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ, পাহাড়ের স্নিগ্ধ ও নির্মল বাতাশে একটু প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার ইচ্ছে। এই ইচ্ছেই পূর্ণ করতে পারে ‘ইচ্ছে গাঁও’। ঘরের কাছেই ঘুরতে যাওয়ার দুর্দান্ত ডেস্টিনেশন। দার্জিলিং-কালিম্পং ছাড়াও কয়েকটি পাহাড়ি এলাকা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে এই রাজ্যে। এরমধ্যে অন্যতম হল ইচ্ছে গাঁও, সিলারি গাঁও। সেই সঙ্গে ডেলো পাহাড়ও রয়েছে, যা কিনা রাজনীতির সূত্র ধরে এখন প্রতিটি বাঙালিই শুনে ফেলেছেন। সবথেকে বড় ব্যাপার এই জায়গাগুলো সপ্তাহান্তের ছুটিতেই ঘুরে আসা যায়।
ইচ্ছেগাঁও-
পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের সীমানা ঘেঁষা ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ হল ইচ্ছেগাঁও (Icchegaon)। কালিম্পং থেকে লাভা হয়ে আরও ১৬ কিলোমিটার দূরে এক স্বপ্নের গ্রাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ইচ্ছেগাঁও-তে ট্রেকিং করেও পৌঁছানো যায়। এই গ্রাম থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা। পাশাপাশি পাহাড়ের ধাপ কেটে তৈরি চাষের ক্ষেত ও ঘরবাড়ি ল্যান্ডস্কেপকে যেন আরও মাধুর্য দিয়েছে। ইচ্ছেগাঁও, স্থানীয় লেপচা ভাষায় যার অর্থ সবচেয়ে উঁচুতে যে গ্রাম। এই গ্রামে মাঝে মধ্যেই নেমে আসে পেঁজা তুলোর মতো হালকা মেঘ। আর যে কোনও উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতাও মনে থাকবে আজীবন। জেনে রাখা ভালো এই গ্রাম ও আশেপাশের এলাকা সয়ংসম্পূর্ণ। কারণ এখানকার লোকজন অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করেন। কোনও রকম রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করেন না তাঁরা। আর রযেছে রঙিন সব ফুল।
চেনা-জানা নানান ফুল এবং অর্কিডের সমাহার এই গ্রামের সৌন্দর্য আরও কয়েকশো গুন বাড়িয়ে দেয়। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ফুলের বাগান। দেখে মনে হতেই পারে আপনি বিদেশের কোনও জনপদে এসে পড়েছেন। এখানে রযেছে বেশ কয়েকটি হোম-স্টে। সেখানকার যে কোনও ঘরে বসেই দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা। আর রাতের আঁধার নামলেও বোর হবেন না। কারণ নিকষ কালো অন্ধকারে ব্যালকনিতে বসে দূষণমুক্ত আকাশে তারার মেলা আর দূরের পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দার্জিলিংয়ের পথে রাতজাগা গাড়িদের হেডলাইটের আনাগোনা দেখে সময় কাটবে, মনও ভরবে। আপনার মন চাইলে ছোট ছোট পাহাড়ি ট্রেক করতে পারেন। পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যেতে পারেন সিলারিগাঁও বা আরও উঁচুতে কোনও পাইন বনে। এই করোনা কালে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে থাকতে অনেকেই অবসাদে ভুগছেন। তাঁদের জন্য ইচ্ছেগাঁও হতে পারে এক টুকরো মুক্তির আশ্বাদ। হিমালয়ের বুকে নির্মল পরিবেশে সবুজ বনানীর ঘেরাটোপে ইচ্ছেগাঁও সত্যিই অনন্য।
সিলারিগাঁও-
সিলারিগাঁওকে মিনি দার্জিলিং বলা হয়। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। তাই জঙ্গলকে পিঠে নিয়ে মেঘ পাহাড়ের দেশ সিলারিগাঁও ঘুরে আসতেই পারেন। কালিম্পং থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরে প্রায় ৬০০০ ফুট উচ্চতায় জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ সিলারিগাঁও। সিলারি’ নামটি এসেছে স্থানীয় একটি গাছের নাম অনুসারে আর গাঁও-এর অর্থ গ্রাম অথবা নদীর পাশে বেড়ে ওঠা বসতি। অর্থাৎ নামেই বুঝতে পারছেন পাহাড়ি নদীর ধারে শান্ত সবুজ এক গ্রামই হল সিলারিগাঁও। এর মাত্র ৫ কিমি আগেই রয়েছে পেডং। সেখানে রয়েছে এক প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফা। সেটি দেখে নিয়ে চুলের কাঁটার মতো পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে উপরের দিকে ওঠা। পথে পড়বে বড় বড় গাছের উপত্যাকা।
সঙ্গে অসংখ্য পাখির কলতান। নিশ্চুপ ভাবগম্ভীর এই উপত্যাকাকে নি:সন্দেহে সাইলেন্ট ভ্যালি বলতে পারেন। কোলাহলহীন, সুন্দর উপত্যকাটি অদ্ভুত রকমের নিঃশব্দ। এই গ্রামেও রয়েছে ফুলের রকমারি সম্ভার। রয়েছে অসংখ্য হোম-স্টে, সেখানেই পাবেন মরশুমি ফুলের ডালি। দূরের পর্বতমালার ক্যানভাসে ভেসে বেরানো মেঘের রাশি এবং ব্যাকড্রপে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কয়েক বছর আগেই সিলারিগাঁওতে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি হোম-স্টে। আজ কমবেশি ৭৫টি হোম-স্টে রয়েছে এই ছোট্ট পাহাড়ি জনপদে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে হয়ত সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে সিলারিগাঁও।
রামধুরা-
কালিম্পং থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে রামধুরা। ছোট্ট এবং নিরিবিলি পাহাড়ি জনপদ হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রামধুরা। ঘন জঙ্গল, অন্ধকার, ঝিঝির গানে মুখরিত রামধুরায় থাকার একমাত্র উপায় হোম স্টে। হিন্দু দেবতা রাম ও ধুরা অর্থাৎ গ্রাম, দুয়ে মিলে রামধুরা। শান্ত ও নিস্তব্ধ এই গ্রাম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রায় ৫৫০০ ফুট উপরে শহর থেকে অনেক দুরে রামধুরায় আসলে ক্লান্ত শরীর ও মন উৎফুল্ল হবেই। দূরে বয়ে চলেছে সুন্দরী তিস্তা। মেঘ ও কুয়াশায় ঘেরা রামধুরা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে অবস্থিত। অফবিট ডেস্টিনেশন হিসেবে রামধুরা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। ইচ্ছেগাঁওয়ের মতোই এখানে অর্গানিক চাষ হয়। গ্রামের মানুষদের যা প্রধান জীবিকা। এছাড়া রয়েছে এলাচ গাছের সমাহার। শষ্য চাষের পাশাপাশি এখানকার অধিবাসীরা ব্যবসায়ীক ভিত্তিতে ফুল ও অর্কিডের চাষ করেন। ফলে গ্রাম্য রাস্তায় ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগবে। এছাড়া হোম-স্টে গুলিতে অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা সবজি-ভাত খেলে মন ভরবেই। আর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই রুটে যাওয়া যায়।
ডেলো পাহাড় (কালিম্পং)-
সাম্প্রতিক অতীতে সারদা কেলেঙ্কারির জেরে এই ডেলো পাহাড় আজ বাঙালিদের কাছে পরিচিত নাম। কালিম্পং শহরের কিছুটা উপরে একটি টিলার ওপর ডেলো বাংলো। এটিই কালিম্পং শহরের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। এখান থেকেই কালিম্পং শহরকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে দেখা যায়। আর সাধারণ বাঙালির কৌতুহল অবশ্যই ডেলো বাংলোকে নিয়ে। সরকারি এই বাংলোয় থাকাও যায়। অনলাইনে বুকিং হয়। বিশাল এলাকা নিয়ে বাগানে ঘেরা সুন্দর সাজানো-গোছানো এই বাংলো। ফেরার পথে অবশ্য এই বাংলো দেখে কিছুটা সময় কাটিয়ে ছবি তুলে কালিম্পং শহরে চলে আসুন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত কালিম্পংয়ে কবিগুরুর নানান ঐতিহাসিক সামগ্রি সহ রয়েছে কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টার। কালিম্পং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গটি খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। ফলে এখান থেকে হিমালয়ের অপরূপ শোভা চেখে দেখার মতো। সন্ধ্যের মুখে চলে আসুন তিস্তা বাজারে। পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এই মার্কেট। ঘুরতে গিয়ে কেনাকাটা হবেনা? তাই তিস্তা বাজারে কেনাকাটা সেরে পরদিন নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ফেরার ট্রেন।
Post a Comment
Thank You for your important feedback