ইতিহাসের খোঁজে কর্ণগড়ে




করোনার জেরে জোর ধাক্কা খেয়েছে পর্যটন শিল্প। নিউ নর্মাল পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষই বাইরে বেশি দূরে নয়, বরং রাজ্যের মধ্যেই ঘুরতে যেতে পছন্দ করছেন।আর এই ট্রেন্ডকে ঘিরেই আশায় বুক বেঁধেছে রাজ্যের পর্যটন শিল্প। স্বভাবতই নতুন নতুন অফবিট জায়গা উঠে আসছে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে। এমনই এক অফবিট এলাকা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করছে  রাজা কর্নের গড়, কর্ণগড়ের নাম। দীর্ঘদিন অবহেলায় থাকতে থাকতে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এই কর্ণগড়। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে সাজানোর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। ফলে দ্রুতই রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নেবে কর্ণগড়, আশাবাদী স্থানীয় বাসিন্দারা।  
 

কর্ণগড়ের ইতিহাস :

মেদিনীপুর শহর থেকে উত্তর দিকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল কর্ণ রাজবংশের রাজধানী। তাদের প্রধান গড় ছিল কর্ণগড়। এটি মেদিনীপুরের প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। স্থানীয়দের মতে এই গড়টি ছিল রাজবংশের সবথেকে বড় গড়। তবে এই গড়টি আকারে বড় হওয়ার পাশাপাশি এর অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যও ছিল বিশেষ। জঙ্গলমহলের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে জলস্রোত পারাং নদীর নামে বয়ে যেত ‌গড়ের পাশ দিয়েই। 


 

আর গড়ের দু'দিক দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়ে একসঙ্গে মিলিত হত, যা পরিখার মত কর্ণগড়কে রক্ষা করত শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে। গড়ের অন্দরে অবস্থিত ছিল, রাজবংশের কুল দেবতা তথা অধিদেবতা দণ্ডেশ্বর এবং অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভগবতী মহামায়ার মন্দির। কথিত আছে দেবী মহামায়ার মন্দিরেই কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য সাধনা করতেন। এই মন্দিরে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন বিখ্যাত কাব্য শিবায়ন। এমনকি "যশোবন্ত সিংহ/ সর্বগুণযুত/ শ্রীযুত অজিত সিংহের তাত। মেদিনীপুরাধিপতি/ কর্ণগড়ে অবস্থিতি/ ভগবতী যাহার সাক্ষাৎ।"--এই মর্মে তাঁর কাব্যে কর্ণগড়ের কথা উল্লেখও করেছেন রামেশ্বর। 



   ১৬৯৩ থেকে ১৭১১ সাল প‌র্যন্ত এই গড়ে রাজ করেছিলেন রাজা রাম সিংহ। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় রাজবংশের শেষ অপুত্রক রাজা অজিত সিংহ, তাঁর দুই রানি ছিলেন ভবানী ও শিরোমণি।তাঁর মৃত্যুর পর রানী শিরোমনি এবং নাড়াজোলের রাজা মোহনলাল খাঁ এই গড়ের উন্নয়ন করেছিলেন। কর্ণগড় ছাড়াও আরও দুটি গড় ছিল রাজবংশের, মেদিনীপুর শহরের উত্তরে বাঁকুড়া যাওয়ার দিকে এগোলেই রাস্তায় পড়বে আবাসগড় ও জামদারগড়। সেখানেও ইতিহাসের বেশ কিছু নিদর্শন মেলে। কিন্তু সময়ের চোরাস্রোতে হারাতে বসেছে সেইসব স্মৃতি। 



 স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও চুয়াড় বিদ্রোহের প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে কর্ণগড়ের। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রজাদের একজোট করে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন রানি শিরোমণি। পরাজিত হলে তাঁকে বন্দি করে ইংরেজ সেনা। শেষপর্যন্ত নাড়াজোলের রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় মৃত্যুদণ্ড বা অন্যকোনও  চরম সাজা না হলেও তাঁকে আবাসগড়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। 



  সংরক্ষণের অভাবে আজ এই গড় অর্থাৎ দুর্গের আর অস্তিত্ব নেই। প্রায় কিছুই অবশিষ্ট না থাকলেও অটুট রয়েছে দেবী মহামায়া ও দণ্ডেশ্বরের মন্দিরটি। উৎকল শিল্পরীতিতে তৈরি এই মন্দিরটিতে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। তাই অপূর্ব এই শিল্পকলার নিদর্শন দেখতে আসা অনুরাগীদের পাশাপাশি ভক্তির টানেও কর্ণগড়ে আসেন ভক্তরা।তবে মন্দিরের পাশাপাশি জঙ্গল ও নদী দিয়ে চারদিক ঘেরা নৈসর্গিক মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যও আকৃষ্ট করে পর্যটকদের।  

 


 মেদিনীপুর শহর থেকে কর্ণগড় খুব বেশি দূরে নয়। সড়ক ও রেলপথে সহজেই পৌঁছনো যাবে এখানে। জেলা প্রশাসনের তরফে কর্ণগড়কে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাস্তা সংস্করণ, পার্ক নির্মাণ ও ঐতিহাসিক স্থানগুলি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। রাণী শিরোমণি দেবীর স্মরণে মেদিনীপুর শহরেই রয়েছে গেস্ট হাউস, এমনকি ভারতীয় রেল রাণী শিরোমনির স্মৃতির উদ্দেশ্যে আদ্রা-হাওড়া প্যাসেঞ্জার ট্রেনও চালু করেছে।পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক রেশমি কমল জানান," গেস্ট হাউসের ঘরগুলি পর্যটকদের উপযুক্ত করার জন্য রাজ্য সরকার বিভিন্ন খাতে টাকা বরাদ্দ করেছে। মন্দিরের উন্নয়নকল্পেও রাজ্য সরকার এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।" স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য জানান, ইতিমধ্যেই রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। আশা রয়েছে, ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই কর্ণগড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে নতুন রূপে আসবে।প্রশাসনের উদ্যোগে উন্নয়নের কাজ শুরু হওয়ায় খুশি এলাকার মানুষ। তাঁদের আশা পর্যটন শিল্পের হাত ধরেই স্থানীয় মানুষদের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। 


কিভাবে যাবেন :


রেল পথে গেলে হাওড়া থেকে মেদিনীপুরগামী যেকোনও লোকাল বা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে প্রথমে পৌঁছতে হবে মেদিনীপুর স্টেশনে। স্টেশন থেকে কর্ণগড়ের দূরত্ব ১২ কি.মি কাছাকাছি। সেখান থেকে যে কোনও ছোট গাড়ি বা অটো করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। আর কলকাতা থেকে সড়কপথে আসতে চাইলে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিলেই পৌঁছনো যাবে এই ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রে।    



Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post