একদৌড়ে গৌড়ে, উইকেন্ডে টহল দিন প্রাচীন মালদায়


হাতে দুই-তিনদিন সময় পেয়েছেন? মানে শনি-রবি ছুটির সঙ্গে একটা দিন এক্সট্রা আর কি। আর মনটাও কয়েকদিন ধরে উড়ুউড়ু করছে? সবমিলিয়ে আপনার বেড়াতে যাওয়ার যোগ প্রবল। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? দিঘা-মন্দারমনি একঘেয়ে হয়ে গেছে প্রায়, নতুন কোনও জায়গার স্বাদ নিতে মন চাইছে? তবে এক দৌড়ে ঘুরে আসুন গৌড়ে। গৌড়বঙ্গ, মধ্যযুগীয় বাংলার রাজধানী। যা আজ মালদা বলেই পরিচিত। ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে আর মালদার বিখ্যাত আম বাগান দেখে মন ভালো করে ফিরে আসুন ঘরে। কলকাতা থেকে দূরত্ব কমবেশি ৩০০ কিলোমিটার। ভারতের প্রাচীন শহরগুলির অন্যতম দিল্লির মতোই গৌড় অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী। 

 

গৌড়ের ইতিহাস-


গৌড়ের উত্থান নাকি রামায়ণের সময়ে। রামের ভাই লক্ষণের হাতেই এই প্রাচীন জনপদের উত্থান। ইতিহাসবিদদের একাংশ দাবি করেন, গৌড়ের প্রাচীন নাম ছিল লখনাউতি। আবার অন্যমতে বাংলার রাজা লক্ষণ সেনের সময়ে এর উত্থান। তাঁর নামেই এই শহর। তবে রাজা শশাঙ্ক থেকে দেবপালের আমল পর্যন্ত ছিল গৌড়ের স্বর্ণযুগ। পঞ্চদশ শতাব্দীর স্থাপত্যগুলি এখনও সেখানে মাথা উঁচু করে রয়েছে প্রাচীন এই শহরে। 

 


 

বিখ্যাত পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ফারিয়া সৌসা গবেষণা করেছিলেন এই গৌড় নিয়ে। তার মতে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের বাস ছিল সুবিশাল প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীতে। আবার পাণিনি তার লেখায় এই অঞ্চলের নাম লিখেছিলেন ‘গৌড়পুরা’। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময় গৌড়ের নাম হয় লক্ষ্মণাবতী৷ পরে মোগলদের দখলে আসে গৌড়। সম্রাট হুমায়ুন এখানকার আমের স্বাদে তৃপ্ত হয়ে এই অঞ্চলের নাম দেন জান্নাতাবাদ৷ ইতিহাসে বিবাদ থাকতেই পারে, তাই বলে বসে থেকে লাভ কি, চলুন বরং প্রাচীন গৌড়বঙ্গের স্বাদ নিতে একটু ঘুরে আসি।


 



মালদা ভ্রমণ-

পুরাতন মালদা ঘুরে দেখতে হলে মোটামুটি দুদিন লাগবে। চলুন শুরু করা যাক, প্রথমেই যাওয়া যাক রামকেলি। এখানে একটি ছোট মন্দির আছে। কিন্তু এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল, এখানে একটি পাথরখণ্ডে শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন রয়েছে। কেউ কেউ বলে প্রভু চৈতন্য নবদ্বীপ থেকে নীলাচল বা পুরী যাওয়ার সময় এখানে এসেছিলেন। আবার কারোর মতে তিনি বৃন্দাবন থেকে ফেরার পথে এখানে কিছুদিন ছিলেন। মন্দির ও শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন ছুঁয়ে এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা। এবারের গন্তব্য মালদার বিখ্যাত বারোদুয়ারি মসজিদ। এটা বলতে পারেন মালদার স্টার অ্যাট্রাকশন।

 
বড়সোনা মসজিদ


ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই বারোদুয়ারি মসজিদ। বর্তমানে এই মসজিদ অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবুও আকর্ষণের মূল কেন্দ্র পর্যটকদের কাছে। বড়সোনা বা বারোদুয়ারি মসজিদের দেওয়ালের ভাস্কর্যে গ্রিক ও আরবী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। গৌড়ের স্থাপত্য কীর্তিগুলির মধ্যে এটি সবথেকে বড়। ইতিহাস বলে, এই মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং শেষ করেন তার পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহ। 

 বারোদুয়ারি মসজিদ

 

এই মসজিদের উচ্চতা ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১৬৮ ফুট ও প্রস্থ ৭৬ ফুট। সংখ্যা দেখেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কত বড় জায়গা জুড়ে ছিল প্রাচীন এই স্থাপত্য। বারোদুয়ারি মসজিদে অতীতে ৪৪টি গম্বুজ থাকলেও এখন মাত্র ১১টি অবশিষ্ট। একসময় এখানে মোট ১২টি প্রবেশদ্বার ছিল, তাই এর নাম বারোদুয়ারি মসজিদ। কালের বিবর্তনে অনেকগুলোই ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে তিন খিলানের মধ্যবর্তী করিডোরটাতে অবশিষ্ট গম্বুজগুলি স্বমহিমায় রয়েছে। ইন্দো-আরবী স্থাপত্যের এক অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল মূলত ইট ও পাথর দিয়ে।

আমাদের পরবর্তী ডেস্টিনেশন সেলামি দরওয়াজা বা দাখিল দরওয়াজা। বলে রাখি, নিউটাউনে বিশ্ববাংলা গেট তৈরি হওয়ার আগে, এটিই ছিল পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় প্রবেশদ্বার বা গেট বা দরওয়াজা। তৈরি হয়েছিল ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বরাবক শাহর আমলে। এর উচ্চতা ২১ মিটার আর দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৩৪ মিটার। এটিই ছিল সুবিশাল গৌড় দুর্গের মূল প্রবেশদ্বার। একসময় এই বিশাল দরজার দুই দিকে কামানের তোপ ধ্বনি দিয়ে সুলতান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্মান প্রদর্শন করা হতো। তাই এর আরেক নাম সেলামি দরওয়াজা। 

 

দাখিল দরওয়াজা

এর কিছুটা দূরেই পেয়ে যাবেন ফিরোজ মিনার। এটি তৈরি করেছিলেন সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। তুঘলকি স্থাপত্যে নির্মিত এই মিনারটি উচ্চতায় ২৬ মিটার, যা পাঁচতলা বিশিষ্ট। যদিও এই ফিরোজ মিনারে চড়ার অনুমতি নেই সাধারণ পর্যটকদের, তবে বাইরে থেকে দেখে ও ছবি তোলা যেতেই পারে। এখান থেকে কিছুটা দূরেই দেখা যাবে বাইশগজি দেওয়াল। স্থানীয়রা বলেন, গরিবের চীনের প্রাচীর। এত মোটা দেওয়াল আর কোথাও পাবেন কিনা সন্দেহ। পাঁচিলটি চওড়ায় ২২ গজ, যা একসময় এই গৌড় দুর্গের সীমানা প্রাচীর ছিল, এখন কিছুমাত্র অবশিষ্ট। 


 ফিরোজ মিনার

এবার চলে আসুন বল্লালবাটি দেখতে। এটা মালদা শহরের নবতম সংযোজন বলতে পারেন। কারণ সম্প্রতি ২০০৩ সালে মাটি খুঁড়ে রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদটি বের করেছেন ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা।  খোঁড়াখুঁড়ি এখনও চলছে, তাই এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বিশদ তথ্য জানা যায়নি।  এখান থেকে ঘুরেফিরে দেখে নিন কদম রসুল মসজিদ, ফতে খানের সমাধি, লুকোচুরি দরজা, চিকা মসজিদ ও গুমতি মসজিদ। প্রত্যেকটিই প্রাচীন মালদার অন্যতম দ্রষ্টব্য। এক গম্বুজ বিশিষ্ট চিকা মসজিদ ১৪৫০ সালে তৈরি। পূর্বে এটি সম্ভবত কোনও সমাধিস্থল ছিল। 



 বল্লালবাটি

কথিত আছে যে সম্রাট হুসেন শাহ এটিকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। পরে মসজিদের রূপ নেয়। আজও স্থাপত্যটির ভিতরের দেয়ালে অনেক হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি রয়েছে। নাম মাহাত্ম- পরবর্তী কালে এখানে চামচিকার উপদ্রব শুরু হলে এর নাম হয় চামকান মসজিদ বা চিকা বা চামচিকা মসজিদ।

কদম রসূল মসজিদে দেখা যায় হজরত মহম্মদের পায়ের ছাপ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মসজিদ খুবই পবিত্র। এর পাশের ফতে খানের সমাধি। স্থাপত্যের বিচারে কম যায়না কোনটিই। আশেপাশের গুমতি মসজিদ আর চিকা মসজিদ প্রায় একই রকম দেখতে। তবে লুকোচুরি দরজাটি লখনউয়ের ভুলভুলাইয়ার মতো না হলেও বেশ সুন্দর। ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড় দুর্গে প্রবেশ করবার জন্য এই লুকোচুরি দরজা তৈরি করেন। উচ্চতা ৬৫ ফুট ও চওড়া ৪২ ফুট। এছাড়া পুরাতন মালদায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটি মসজিদ। কারুকার্যে কোনোটিই কম নয়। ঘুরে আসতে পারেন ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। এছাড়া মালদার বিখ্যাত আম বাগান তো আছেই।

চিকা মসজিদ

এছাড়াও অবশ্যই দেখবেন আদিনা মসজিদ। মালদা শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে দেখে নিন  আদিনা মসজিদ।  সিকন্দর শাহ ও গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের আমলে নির্মিত হয়েছিল এই বিখ্যাত আদিনা মসজিদ। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫২৪ ফুট লম্বা ও ৩২২ ফুট চওড়া। দোতলায় রয়েছে মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গা। বলা যেতে পারে এটিই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ। পাশেই রয়েছে সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধি। সমাধিটিতে টেরাকোটা ও ইটের সূক্ষ কারুকাজ দেখার মতো। আদিনা মসজিদ দেখে চলে আসুন ডিয়ার পার্কে। শাল, সেগুনে ঘেরা এই এলাকায় রয়েছে ১০০-রও বেশি চিতল হরিণ, নীলগাই, হরিণ প্রভৃতি।

 

আদিনা মসজিদ


কিভাবে যাবেন আর কোথায় থাকবেন?

মালদা যাওয়ার জন্য ট্রেন ও বাস দুটোই পেয়ে যাবেন। কলকাতা থেকে দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার মতো। হাওড়া ও শিয়ালদা থেকে উত্তরবঙ্গ ও অসমগামী যেকোনও ট্রেন মালদা হয়ে যায়। তবে ভালো হয় শিয়ালদা থেকে গৌড় এক্সপ্রেস ধরলে। ট্রেনটি প্রতিদিন রাত ১০টা ১৫ মিনিটে শিয়ালদা স্টেশন ছেড়ে মালদা পৌঁছায় পরদিন ভোরে। ফিরতি পথেও একরাতের জার্নি। এছাড়া ধর্মতলা থেকে সরকারি বেসরকারি এসি ও নন এসি বাস চলাচল করে মালদা পর্যন্ত। থাকার জন্যও প্রচুর হোটেল ও গেস্ট হাউস রয়েছে মালদা শহরে।



Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post