না থেকেও রয়ে গেলেন ‘সংগ্রাম’

মাত্র তিন বছর আগে বিয়ে করেছিলেন ভাটপাড়ার সংগ্রাম ভট্টাচার্য। পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ সংগ্রাম স্ত্রীর কাছে তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর পর দেহ ও অঙ্গদান করতে চান। গত শুক্রবার নদিয়ার কল্যাণীতে এক চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফেরার পথেই বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন ৩২ বছরের সংগ্রাম ভট্টাচার্য। প্রথমে কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু মেডিকেল কলেজ ও পরে বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। শনিবারই অ্যাপেলো হাসপাতালের চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, ব্রেন ডেথ অনিবার্য সংগ্রামের। তাই খবর যায় Regional Organ and Tissue Transplant Organisation (ROTTO)-এর আধিকারিকদের কাছে। তাঁরাই দু’দফায় সংগ্রামের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রবিবার রাতেই নিশ্চিন্ত হন ব্রেন ডেথ সম্পর্কে।
এই খবর পেয়ে একেবারেই ভেঙে পড়েননি সংগ্রামের পরিবার। সংগ্রামের বাবা সুসীম ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমার দাদা দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। গতবছর তিনি মারা যান। ছেলে বোধহয় দাদার সিদ্ধান্তে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণার পরে বৌমা বলল, ছেলেরও অঙ্গদানের ইচ্ছা ছিল। পরিবারের সকলে মিলে সম্মতি দিই’। এরপরই খোঁজ শুরু হয় অঙ্গ গ্রহীতাদের। এই করোনা আবহে সেটা একেবারেই সহজ কাজ ছিলনা। অঙ্গগ্রহীতা মিললেও তাঁদের করোনা হয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়া দরকার। আবার যে সমস্ত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সকলেরই করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ হতে হবে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে শুরু হয় তোড়জোড়। আর সোমবার দিনভর তৎপরতার সঙ্গে চারজনের শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে সংগ্রামের চারটি অঙ্গ। আর তাঁর ত্বক ও কর্নিয়া দুটি সংরক্ষিত করা হয়েছে যথাক্রমে এসএসকেএম হাসপাতালের স্কিন ব্যাঙ্কে ও দিশা আই হাসপাতালে।
অ্যাপোলো হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার রাতেই অঙ্গ আহরণ ও প্রতিস্থাপনের (Retrival and Hervesting) জন্য ৫৬ জনের একটি দল গঠন করা হয়। তাঁদের প্রত্যেকেরই আরটি-পিসিআর জিন এক্সপ্রেশন পরীক্ষা করে চটজলদি দেখে নেওয়া হয় তাঁরা কোভিড নেগেটিভ কিনা। একইভাবে অন্য হাসপাতালের চিকিৎসক দল ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও কোভিড পরীক্ষা করানো হয় তড়িঘড়ি। সোমবার সন্ধ্যায় কলকাতা ও হাওড়া পুলিশ দুটি গ্রীন করিডর তৈরি করে সংগ্রামের অঙ্গ শহরের তিনটি হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেয়। এরপরই শুরু হয় ম্যারাথন অস্ত্রোপচার। জানা গিয়েছে, হাওড়ার নারায়ণা সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতালে পূর্ব মেদিনীপুরের এক বছর সাতেরোর কিশোরীর শরীরে হার্ট প্রতিস্থাপিত হয়। সূত্রের খবর, এত কম বয়েসী কারও শরীরে হার্ট প্রতিস্থাপনের নজির নেই পূর্ব ভারতে। অ্যাপোলো হাসপাতালেই সংগ্রামের লিভার প্রতিস্থাপিত হয় আগরতলার ৫৯ বছর বয়সী এক রোগীর শরীরে। একটি কিডনিও সেখানে লিলুয়ার এক যুবকের শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আরেকটি কিডনি কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
ফলে মাত্র ৩২ বছর বয়সে সংগ্রামের জীবনসংগ্রাম থেমে গেলেও অন্য অনেকের থেমে থাকা জীবন শুরু হল। অপরদিকে, করোনা আতঙ্কে যখন অঙ্গদানের প্রক্রিয়া কার্যত থেমে ছিল। ভাটপাড়ার সংগ্রামের পরিবার অঙ্গদানের সম্মতি মানবিকতার এক অনন্য নজির গড়ল। রিজিওনাল অর্গান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজেশন’ (রোটো) সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ২০ মার্চ শহরে শেষ অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছিল। লকডাউন শুরু হওয়ার পরে ১৫ অগস্ট পর্যন্ত অঙ্গদানের প্রক্রিয়া কার্যত থমকেই ছিল। করোনা কালে সেই লকগেট ভাঙল সংগ্রামের পরিবার।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

أحدث أقدم