বর্তমান সময়ে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘাত সীমাবদ্ধ লাদাখে। তবে এর আগে ভারতের অপর এক রাজ্য নিয়েও ভারত-চিন সংঘাত তৈরি হয়ে আছে। সেটা হল অরুণাচল প্রদেশ। এই রাজ্যের বেশ কিছু এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে আসছে চিন। বেশ কয়েকবার লালফৌজ বেআইনিভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশও করেছে। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহসীকতা ও দক্ষতায় তাঁরা প্রতিবারই বিফল হয়েছে। এবার আমাদের গল্প অরুণাচলের পর্যটন নিয়ে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রান্তিক রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ। আক্ষরিক অর্থেই প্রান্তিক, কারণ ভৌগলিক দিক থেকে এই রাজ্যের অবস্থান বেশ দুর্গম। তবে প্রাকৃতিক ঐশর্য্য ও বৈচিত্রে ভরা এই রাজ্য ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলি থেকে কোনও অংশে কম যায়না। অরুণাচলের আয়তন প্রায় ৮৪ হাজার বর্গ কিমি। বিশাল এই ভূখণ্ডে রয়েছে বিস্তীর্ণ পর্বতশ্রেণী, আদিম অরণ্য, অসংখ্য নদী, ঝর্ণা, দুর্গম গিরিপাস আর বরফের সাম্রাজ্য। ফলে অরুণাচল আজকে পর্যটকদের কাছে স্বর্গরাজ্য। এই অরুণাচল প্রদেশেই রয়েছে ২৬টি বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠী।
যদিও বৈচিত্রময় এই রাজ্যে ঘুরতে এলে লাগবে ইনারলাইন পারমিট। তবে সেটা কলকাতার উপকণ্ঠ সল্টলেক থেকেই পাওয়া যাবে। পর্যটনের স্বর্গরাজ্য হলেও এখানে পর্যটনের উপযুক্ত পরিকাঠামোই গড়ে ওঠেনি। ফলে আজও অরুণাচল প্রদেশ দুর্গম, তাই এখানে পর্যটক সমাগম বেশ কম। তবে বর্তমানে পশ্চিম অরুণাচলের ভালুকপং, বমডিলা, তাওয়ান, দিরাং শহরকে কেন্দ্র করে পর্যটনের পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে অনেকটাই। ফলে এই অঞ্চলে পর্যটক সমাগম ভালোই হচ্ছে। অরুণাচল ভারতের একেবারে পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত, তাই অরুণাচলে পৌঁছাতে হলে আপনাদের গুয়াহাটি হয়েই আসতে হবে। কলকাতা থেকে গুয়াহাটি ট্রেন ও বিমানপথে সহজেই পৌঁছানো যায়। এখান থেকেই শুরু হোক আমাদের অরুণাচল ভ্রমণ।
বমডিলা-
কলকাতা থেকে গুয়াহাটি পৌঁছে একরাতের বিশ্রাম, পরদিন তেজপুর হয়ে বমডিলা। গুয়াহাটি থেকে বমডিলার দূরুত্ব ৩৪২ কিমি, তাই দীর্ঘ এই সড়কপথে তেজপুরে একরাত্রি কাটানোই শ্রেয়। তাহলে পথের ক্লান্তি লাঘবও হবে আবার কিছুটা সময় নিয়ে ছবি তুলে পথের শোভা দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। তেজপুরে সরকারি ট্যুরিস্ট লজ ছাড়াও পেয়ে যাবেন কয়েকটি ভালো হোটেল। আর একটা কথা, এই পথে গাড়ি ভাড়া করে গেলেই ভালো, এছাড়া সুপারফাস্ট বাস ও শেয়ার টাটা সুমো জাতীয় গাড়ি পেয়ে যাবেন।
তেজপুর থেকে মাত্র ৬০ কিমি দূরে ভালুকপং, এই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ. তবে ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন ভালুকপং। আমরা চলেছি সোজা বমডিলা। তেজপুর থেকে এই পথে চোখে পড়বে প্রাচীন বনস্পতির জঙ্গল। বুনো কলাগাছ, বিশাল বিশাল ট্রি-ফার্ন, বাঁশ গাছের ঘন জঙ্গল। পথের পাস দিয়েই প্রবাহিত কামেং নদী। এই পথে যেতে যেতে অতিক্রম করতে হবে রূপা ও টেঙ্গা ভ্যালি। চিনের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় এই অঞ্চলে প্রচুর সেনাছাউনিও চোখে পড়বে। ভালুকপং থেকে ১০০ কিমি দূরে বমডিলা। যার উচ্চতা ৮,২০০ ফুট। বমডিলাকে মেঘের দেশ বলা হয়। কারণ সকালের দিকে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও বেলা বাড়তেই কোথা থেকে মেঘের দল এসে হাজির হয়ে যায় কে জানে। ফলে দিনভর সূয্যিমামা ও মেঘের লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে এই শহরে। বমডিলা বাজারের কাছেই রয়েছে এক প্রাচীন বুদ্ধমন্দির, স্থানীয়দের কাছে এটা লোয়ার মনাস্ট্রি বলেই পরিচিত। এখানে অসাধারণ ফুলের বাগানে বসে মেঘ-রোদের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে।
লোয়ার মনাস্ট্রির অদূরেই রয়েছে সরকারি ক্রাফ্ট সেন্টার। উপজাতীয় শিল্প সংস্কৃতির অসাধারন সংগ্রহ দেখতে হলে এখানে আসতেই হবে। স্থানীয় উপজাতি মনপা, মিজি ও শেরদুকান জনজাতির কারিগরদের অসাধারণ শিল্পকর্ম ও হস্তশিল্পের নমুনা দেখে হতবাক হতেই হবে। এরপর দেখে নিন উপজাতীয় লোকসংস্কৃতি মিউজিয়াম। পশ্চিম অরুণাচলের স্থানীয় উপজাতির জীবনযাত্রার নমুনা, বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট এই সংগ্রহশালায় সযত্নেই রাখা আছে এখানে। সবশেষে চলে আসুন আপার মনাস্ট্রি, এখানে যেতে হলে কিছুটা চড়াই ভাঙতেই হয়। বমডিলার আপার মনাস্ট্রি থেকে আশেপাশের ভিউ ও পুরো শহরের দৃশ্য অসাধারণ। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের পর স্থানীয় এক লামা থুস্পেন যুমপেন এই মনাস্ট্রিটি তৈরি করিয়েছিলেন। পরদিন যাবো দিরাং।
দিরাং-
বমডিলা থেকে দিরাংয়ের ৪০ কিমি। কথা দিলাম, সামান্য এইটুকু পথই আপনার সারা জীবনের মনে রাখার মতো জার্নি হয়ে দাঁড়াবে। দিরাংয়ের উচ্চতা বমডিলার থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে। কিন্তু পথের অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা পথের ক্লান্তি মুছে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। দিরাং শহরটি গড়ে উঠেছে দিরাং নদীর তীরে। নদীর নামেই শহরের নাম। ছোট্ট ও শান্ত জনপদ দিরাং, দূষণমুক্ত পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এখানে প্রকৃতির কোলে এক-দুই দিন কাটিয়ে দিতে মন্দ লাগবে না। এখান থেকেই ঘুরে আসা যায় স্যাংতি ভ্যালি। এই পথে দেখে নেওয়া যায় ইয়াক রিসার্চ সেন্টার, ফলের বাগান ও উষ্ণ প্রস্রবণ সহ আরও অনেক কিছু। পাশাপাশি এই পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করবেই। শান্ত নির্জন দিরাং সফর আজীবন মনে রাখার মতো। পরদিন আমরা যাবো তাওয়াং। প্রকৃতিক সৌন্দর্যে এই এলাকা বিশ্বের যে কোনও শহরকেই টেক্কা দিতে পারে।
তাওয়াং-
দিরাং থেকে তাওয়াং যাওয়ার পথেই পড়বে সেলা পাস। এর উচ্চতা ১৩,৭২১ ফুট, দিরাং থেকে যার দূরত্ব ৪০ কিমি। মনে রাখবেন সেলা পাস পেরোতে হলে একের পর সেনাছাউনি পার করতে হবে। সঙ্গে অবশ্যই রাখতে হবে ইনার লাইন পারমিট। আর একটা কথা এই সেলা পাস অতিক্রম করার সময় যা যা দৃশ্য চোখে পড়বে তা আজীবন মনে থাকবে। তবে সেটা কপালের ওপর নির্ভর করবে, কারণ সেলা পাসের আবহাওয়া বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হতে থাকে। সেলা পাসের উপর রয়েছে এক শিব মন্দির, আর ওপর থেকে দেখা যায় সেলা লেক। তবে এই পথের গুরুত্ব সামরিক দিক থেকে অপরিসীম। তাই এই পথ শীতেও খোলা থাকে। এর পরই উৎরাই পথ, পথে পড়বে যশবন্তগড় ও জং শহর। আর জং থেকে তাওয়াং যাওয়ার রাস্তায় পড়বে নুরানাং নাম এক সুন্দর জলপ্রপাত।
বমডিলা থেকে তাওয়াং ১৮০ কিমি। এই শহরের উচ্চতা ১০,২০০ ফুট, যা প্রায় লাদাখের সমতুল। ফলে এখানে শীতের প্রাবল্য অনেক বেশি। সুপ্রাচীন তাওয়াং মনাস্ট্রি ঘিরেই এখানকার পর্যটন আবর্তিত। প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন এই বৌদ্ধ মন্দির। এখানে রয়েছে ২৬ ফুটের অপরূপ এক বুদ্ধমূর্তি। ধূপের সুবাস, বৌদ্ধ লামাদের মন্ত্রোচ্চারণ আর তিব্বতি ঢাকের শব্দের জন্য এই বৌদ্ধ মঠের পরিবেশ বেশ মনোরম। পাশেই রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুনিদের আরেকটি মঠ আন্নি গুম্ফা। এখানেও সাধারণ পর্যটকদের প্রবেশ অবাধ। তাওয়াং থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে ঘুরে আসুন সাঙ্গেতসার লেক, পি টি সো (লেক) আর ভারত-চিন সীমান্ত বুম-লা। এটি একটি গিরিপাস, যা অতিক্রম করে ১৯৬২ সালে চিনা সেনা ভারতে ঢুকে পড়েছিল। তাওয়াং শহরে দেখার মতো রয়েছে ক্রাফ্ট সেন্টার ও সেলস এম্পোরিয়াম।
ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক দিক থেকে তাওয়াং শহরের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ লাদাখের কয়েকটি অঞ্চলের মত তাওয়াংকেও চিন নিজেদের অংশ বলে মনে করে। ১৯৬২ সালে এই নিয়ে ভারত-চিন যুদ্ধও হয়েছিল। সেসময় তাওয়াং দখল করেছিল চিন। পরে অবশ্য এই অঞ্চলটি ফের ভারতের দখলে আসে। এখানে একটি ওয়ার মেমোরিয়াল আছে। যেখানে ৬২-র যুদ্ধের অনেক সংগ্রহ রাখা আছে। তাওয়াংয়ে দ্বিতীয় দিন চলুন বুম-লা। চিন সীমান্তে অবস্থিতি এই গিরিপাসের রাস্তা খুবই খারাপ ও ভাঙাচোরা। তাওয়াং থেকে ২২ কিমি দূরেই রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়েছে। একটি গেছে বুম-লা অন্যটি সাংগাটসার লেক। পুরো রাস্তা খারাপ হলেও প্রাকৃতিক শোভা খুবই সুন্দার।
কুয়াশা ঢাকা পাহাড়, মেঘ-রোদের ফাঁকে বরফাবৃত পর্বতশ্রেণীর দৃশ্য মনকে ছুঁয়ে যাবে। ১৫,২০০ ফুটের বুমলা পাসে শারীরিক কষ্ট হতেই পারে। কিন্তু সেখানে থাকা সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। তাঁদের সঙ্গে থাকে অক্সিজেন ও বিশেষ এক ধরণের স্প্রে। যার সাহায্যে দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠা যায়। সেনা জওয়ানরাই রাস্তা দেখিয়ে দেন ভারতের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। কাঁটাতারের একটি গেট, যার অপর প্রান্তে চিন, এই প্রান্ত ভারতের। ফলে এক্কেবারে চিন সীমান্তে পৌঁছে রমাঞ্চিত হতেই পারেন। বুম-লা যাওয়ার পথের ধারেই পড়বে পিটি সো বা পিটি লেক। আর সাংগাটসার লেকটি ১৯৭১ সালের ভূমিকম্পে সৃষ্টি হয়েছিল।
إرسال تعليق
Thank You for your important feedback