প্রথম দর্শনেই দেখে মনে হবে যেন আপনি পৌঁছে গিয়েছেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। কিন্তু না, দেখতে অবিকল দক্ষিণেশ্বর মেট্রোর মতো হলেও এটি কিন্তু অন্নপূর্ণা মন্দির। জায়গাটিও খুব দূরে নয়। কলকাতার উপকন্ঠ ব্যারাকপুরে। প্রাচীন শহর ব্যারাকপুর, ব্রিটিশ আমল থেকেই এই শহরের গড়িমা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের অন্যান্য প্রান্তে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে হুগলি নদী, তাঁর পাশেই একের পর এক চটকল। আর ঘাটে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। এমনই এক মন্দির হল অন্নপূর্ণা মন্দির। যা রাসমণি ঘাটের পাশেই। এই মন্দির তৈরি করান রানি রাসমণির কন্যা জগদম্বাদেবী। এর ইতিহাসও অপূর্ব। সালটা ১৮৪৭, কথিত আছে একবার জামাই মথুর মোহন বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে কাশির অন্নপূর্ণা দর্শনে যাচ্ছিলেন রাণী রাসমণি। সেসময় জলপথই ছিল একমাত্র ভরসা। হুগলি নদী ধরে তাঁদের বজরা যাওয়ার সময় ব্যারাকপুরের কাছে শুরু ঝড়বৃষ্টি। ভয়ানক এক দুর্যোগের কবলে পড়েন রানি ও তাঁর বজরা। ফলে সেখানেই নোঙর ফেলা হয় রাতের জন্য।
সেই রাতেই রানির স্বপ্নে দর্শন দেন দেবী অন্নপূর্ণা। এবং আদেশ দেন, কাশী না গিয়ে তিনি যেন ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে মন্দির নির্মাণ করে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করতে। এর পরে রানি রাসমণি কাশীযাত্রা স্থগিত করে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৫৫ সালে। কিন্তু রানির সঙ্গেই তাঁর জামাই মথুর মোহন বিশ্বাস কাশি যাত্রা করছিলেন। কিন্তু এই দুর্যোগের কারণে তাঁরও কাশি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই তিনি মনে মনে ভাবলেন দেবী অন্নপূর্ণার এক মন্দির তৈরি করাবেন। ঠিক সেই জায়গাতেই মন্দির বানাবেন যেখান থেকে তাঁদের ফিরে আসতে হয়েছে। তবে সেই ইচ্ছা তিনি পুরণ করে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর স্বামীর ইচ্ছা পুরণ করেন স্ত্রী জগদম্বাদেবী। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠার ঠিক ২০ বছর পরে ১৮৭৫-এর ১২ এপ্রিল চাণক-এ অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। আর ইতিহাসের চাণক নগরীই হল আজকের ব্যারাকপুর। জানা যায়, দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণে যে কারিগররা নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদেরই অনেকে ছিলেন জগদম্বা দেবীর অন্নপূর্ণা মন্দির তৈরির সময়। সে যুগে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মতোই নবরত্ন শৈলিতে তৈরি ব্যারাকপুরের শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দিরটি। এখানে রয়েছে নাটমন্দির ও শিব মন্দির। তবে দক্ষিণেশ্বরের মতো ১২টি নয়। ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দিরে রয়েছে ৬টি আটচালার শিব মন্দির। মূল নবরত্ন মন্দিরটি পঙ্খের কারুকার্যমণ্ডিত নয়টি চূড়াবিশিষ্ট। পাশেই রয়েছে বিশাল নহবৎখানা এবং ভোগের ঘর। নাটমন্দিরটিও দেখার মতো। নাটমন্দিরটি গথিক স্থাপত্যে নির্মিত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সিংহ। জানা যায় সেটি সরিয়ে ফেলার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের প্রবল চাপ ছিল। মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে সেটি যথাস্থানেই থেকে যায়। ৬টি শিবমন্দির যথাক্রমে কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর, ও কপিলেশ্বর।
এই মন্দিরটির আদল অবিকল দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলে হলেও দৈর্ঘ্য ও প্রস্তে অনেকটাই ছোট। মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা। মূল বিগ্রহটি অষ্টধাতুর। দেবী বেনারসী শাড়ি ও স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা। দেবীর চালচিত্র ও সিংহাসন রুপোর তৈরি। মন্দিরে প্রতিদিনই অন্নভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। তবে প্রতিমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে হয় বিশেষ পুজো। এখানে বলার বিষয় হল মায়ের ভোগে মাছ দিতেই হবে। আগে পাঁঠাবলি হলেও এখন তা বন্ধ। এই মন্দিরে অন্নকূট উৎসব হয় কালী পুজোর পরদিন। আর অন্নপূর্ণা পুজোর দিন হয় বিশেষ পুজো।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য-
ট্রেনে এলে ব্যারাকপুর স্টেশনে নামতে হবে। এরপর অটোরিকশ করে যেতে হবে তালপুকুর বাসস্টপ যেতে হবে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিকশ করে যাওয়া যায় রাসমণি ঘাট। গাড়ি বা বাসে এলে বি টি রোডের তালপুকুর বাস স্টপে নেমে হেঁটে বা রিকশ করে যাওয়া যায় অন্নপূর্ণা মন্দিরে।
إرسال تعليق
Thank You for your important feedback