বিশাখাপত্তনম-আরাকু-হায়দরাবাদ (দ্বিতীয় পর্ব)


আগের পর্বে বিশাখাপত্তনমের মূল আকর্ষন সমুদ্র সৈকতগুলি নিয়ে বলা হয়েছে। এই পর্বে আমরা জানবো বিশাখাপত্তনমের অন্যান্য দৃষ্টব্যগুলি সম্পর্কে। পাশাপাশি আরাকু ভ্যালির সৌন্দর্য সম্পর্কেও বিস্তারিত জানবো। বিশাখাপত্তনম শহরের ১৬ কিমি দূরে পাহাড়ের গায়ে চলে যান সীমাচলম। পাহাড়ের গায়ে রয়েছে নৃসিংহ মন্দির। ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের অন্যতম নৃসিংহ অবতার। দক্ষিণ ভারতীয় শৈল্পিক দক্ষতায় নির্মিত মন্দিরটির নির্মাণকাল ত্রয়োদশ শতক। এখানে মূল  বিগ্রহ সারা বছরই চন্দনের পুরু আস্তরণে ঢাকা থেকে, শুধু অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ১২ ঘন্টার জন্য মূল বিগ্রহ দেখতে পারেন সাধারণ দর্শনার্থীরা। তবে মন্দির গাত্রে অপরূপ কারুকার্য পর্যটকদের মন কাড়ে। দুপুর ২টো থেকে ৩টে পর্যন্ত বন্ধ থাকে এই মন্দির। এবার চলুন কৈলাশগিরি পাহাড়ের চূড়ায়। এখান থেকে বিশাখাপত্তনম শহরের এরিয়াল ভিউ ও বঙ্গোপসাগরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পাবেন। এই পাহাড়ের মাথায় রয়েছে সুন্দর সাজানো গোছানো পার্ক, উদ্যান ও টয়ট্রেন, আছে রোপওয়ে। এখানে বিশাল আকারের শিব-দুর্গা মুর্তিটিও পর্যটকদের কাছে সমান আকর্ষণীয়।


আরাকু ভ্যালি

আগেই বলেছি, বিশাখাপত্তনমের পর আরাকু ভ্যালি ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। কারণ এই পথে সড়ক ও রেল দুই পথেই চলার মজা এক ও অনবদ্য। তবে ভাইজ্যাক-কিরণডুলু প্যাসেঞ্জারে যাওয়া বেশি আরামদায়ক ও উপভোগ্য। কারণ এই ট্রেনে একটি ভিস্তাডোম কোচ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে পুরো পথের দৃশ্য খুবই সুন্দরভাবে দেখা যায়। বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকুর দূরত্ব ১১৫ কিমি। যা পুরোটাই পূর্বঘাট পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে। আরাকুর উচ্চতা ৩১০০ ফুট, পুরো রাস্তাই অসাধারণ সুন্দর।  পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি ট্যানেল, ব্রিজ পার করে যায় ট্রেনটি। আবার পথেই দেখা মেলে অনেক ঝর্ণা। এই ট্রেনের পিছনে জুড়ে দেওয়া ভিস্তাডোম কামরায় পুরোটাই প্রায় কাঁচ দিয়ে ঘেরা, ফলে পথের চারিদিক দেখতে হলে এই কামরা বেস্ট।


আরাকু ভ্যালিতেও ঘুরে দেখার বহু জায়গা আছে। যেমন বোরা গুহা, আদিবাসী মিউজিয়াম। এই এলাকার প্রাচীন আদিবাসীদের জীবনযাপনের চলচিত্র দেখতে হলে এই আদিবাসী মিউজিয়ামে যেতেই হবে। নানান মডেলের মাধ্যমে সবকিছু দেখানো হয়েছে। দেখা যায় স্থানীয় আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, পোশাক আশাক, অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রীর নমুনা। এছাড়া পাবেন আদিবাসীদের তৈরি নানান হস্তশিল্প ও মশলা। এই মিউজিয়ামের পাশেই একটি লেকে রয়েছে বোটিংয়ের ব্যবস্থা। এরপর ঘুরে নিন, বোরাগুহালু, বা গুহা।  প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এই গুহা আরাকু ভ্যালির মুখ্য আকর্ষণ। আরাকুর আরও দেখার জায়গা চাপ্পারাই ও ডুমুরা ঝর্ণা। ১২ কিলোমিটার দূরে ঘুরে দেখে নিন সাপরাই শুটিং স্পট। একরাত্রি কাটিয়ে চলে আসুন বিশাখাপত্তনম। 

হায়দরাবাদ

এবার আমাদের গন্তব্য হায়দরাবাদ। মুসি নদীর তীরে ভারতের প্রাচীন শহর ও বর্তমান তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদ। ১৫৯১ সালে কুতুব শাহ এই শহরের পত্তন করেন এই শহরের।  অতীতে এই শহরের নাম ছিল ভাগ্যনগরি। বর্তমানে এই নামের দাবি তুলেছে বিজেপি নেতৃত্ব। শহরের মূল আকর্ষণ চারমিনার, যা শহরের প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।  মহম্মদ কুলি কুতুবের আমলে ১৫৯১ সালে চার মিনার বিশিষ্ট এই স্থাপত্যের নির্মাণ হয়েছে। ৫৬ মিটার উচ্চতার এই খিলান আসলে একটি চৌকোনা তোরণ। বর্তমানে অসাধারণ আলোর মালায় সাজানো হয়েছে। সন্ধ্যের পর চারমিনার দেখা ও ছবি তোলার অভিজ্ঞতা আলাদাই হবে একথা বলাই বাহুল্য। 

এর কাছেই রয়েছে মক্কা মসজিদ, যা দশ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলিমের প্রার্থনার জন্য উপযোগী। ১৬১৪ সালে এই বিশাল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হলেও শেষ হতে হতে হয়ে যায় ১৬৮৭ সাল। ততদিনে ঔরঙ্গজেব গোলকুন্ডাকে নিজের অধীনে নিয়ে এসেছেন। স্থাপত্য ও কারুকার্যে এই মসজিদ অনন্য। এরপরেই দেখে নিন সালার জং জাদুঘর। এক নিজামের মুখ্যমন্ত্রী সালার জং এই মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয় এটি পৃথিবীর একক বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এতে প্রায় ৩৫,০০০ স্থাপত্য ও দুর্লভ সংগ্রহ দেখতে পাবেন। পুরো ভালোভাবে ঘুরে দেখতে একদিন লেগে যাবে। 

হায়দরাবাদের অদূরে অবস্থিত গোলকুন্ডা ফোর্ট বা দুর্গ। ১২০ মিটার উঁচু পাহাড়ের মাথায় এই অপরূপ দুর্গের অবস্থান। দুর্গের কারুকাজ দেখার মত, কারিগরি দিক থেকেও অনন্য। গোলকুন্ডা ফোর্টের প্রবেশদ্বারে কেউ হাততালি দিলে দুর্গের মাথায় সুরক্ষাকক্ষ থেকেও শোনা যায়। এতটাই উচ্চ কারিগড়িতে নির্মিত এই দুর্গ। এর ভিতরেই রয়েছে সুন্দর বাগান, এখানেই কুতুব শাহি সম্রাটদের সমাধি রয়েছে। গোলকুন্ডা দুর্গ দেখতেও অনেকটা সময় লেগে যাবে। হায়দরাবাদের যমজ শহর হল সেকেন্দ্রাবাদ। একটি প্রাচীন নিজামের শহর, অন্যটি ঝাঁ চকচকে আধুনিক। আর এই দুই শহরকে আলাদা করেছে হুসেন সাগর লেক। মধ্যিখানে লুম্বিনী বুদ্ধের এক অপরূপ স্ট্যাচু এই লেকের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে। এছাড়া লেকের পাশেই রয়েছে লুম্বিনী পার্ক। রাতের আলোকমালায় সজ্জিত দুই শহরের প্রতিচ্ছবি দেখার অভিজ্ঞতাও মনোরম। তাই সন্ধ্যের সময় এখানে ঘোরার সেরা সময়। এই লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। এছাড়া দেখে নিন বিড়লা মন্দির। পাহাড়ের উপর অবস্থিত সাদা মার্বেল পাথরের মন্দিরটি অপরূপ কারুকার্যমন্ডিত। আর বাড়তি পাওনা এখান থেকে হুসেন সাগর লেকের এরিয়াল ভিউ। 

কিভাবে যাবেন?


হাওড়া থেকে সেকেন্দ্রাবাদের সরাসরি ট্রেন আছে। হাওড়া থেকে প্রতিদিন সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে ছেড়ে পরদিন সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে পৌঁছায় সেকেন্দ্রাবাদ। এছাড়াও আরও ট্রেন রয়েছে কিন্তু করোনা আবহে এই একটি ট্রেনই চলাচল করছে। তবে ভাইজ্যাক যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি ট্রেন চলছে। ভালোকরে দেখে নিয়ে টিকিট কাটুন। একরাত্রির জার্নি, তাই সহজেই পৌঁছে সেদিন থেকেই বিশাখাপত্তনম ঘুরতে পারেন। ভাইজ্যাক থেকে সেকেন্দ্রাবাদ যাওয়ার কয়েকটি ট্রেন আছে, সময় লাগে ১২-১৩ ঘন্টা।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

أحدث أقدم