ক্ষীরাই হল নদীর নাম, আর ওই নদীর নামেই একটি ছোট্ট জনপদ। গঞ্জগ্রাম বললেও ভুল হবে না। কিন্তু শীতের কয়েকটা মাস, এই গঞ্জগ্রামটি অপরূপ ফুলের সাজে সেজে ওঠে। এখানে সবটাই যেন বড় একটা ক্যানভাসে আঁকা ছবির মত। চারদিক রঙিন ও সুন্দর। কি ভাবছেন, কোনও পাহাড়ি উপত্যকার কথা বলছি? নাহ, একেবারেই নয়।
ক্ষীরাই হল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাশকুড়ার কাছের একটি গ্রাম। আর পাঁচটা বাংলার গ্রামের মতোই এখানে নদী, পুকুর, মাঠ, চাষের জমির নির্ভেজাল স্বাদ পাবেন। তবে কেন ক্ষীরাই যাওয়া? কারণ ফুলের উপত্যকা বলেই পরিচিত ক্ষীরাই। ছোটবেলা থেকেই আমরা বাংলা-হিন্দি সিনেমায় দেখি নায়ক-নায়িকারা ফুলের বাগানে ঘুরে ঘুরে গান গাইছেন। যদি মন চায় আপনিও এরকম কিছু করবেন তবে আপনাকে যেতেই হবে ক্ষীরাই। ভিনরাজ্যে যাওয়ার দরকার নেই। কলকাতার খুব কাছেই পাবেন এই ‘Valley of Flowers’।
ক্ষীরাইতে হাজার হাজার ফুলগাছের সারি, গোটা শীতকালেই উত্তgরে হওয়ায় দোলা খায়। যেন ফুলের মেলা, রঙের মেলায় বসেছে এখানে। বাতাসে ফুলের মিশ্র গন্ধ, আর শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে ছবি তুলুন প্রাণ খুলে। যেদিকেই যাবেন হরেক কিসিমের গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, রজনী, গোলাপ আরও কত কী।
দুর্গাপুজোর আগে থেকে শুরু করে পরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ক্ষীরাই ভরে ওঠে ফুলের সমাহারে। কাঁসাই ও ক্ষীরাই নদী কিছুটা দূরত্বে সমান্তরাল বয়ে চলেছে। আর এই দুই নদীর মধ্যবর্তী উপত্যকায় যত ফুলের রাজত্ব। মাইলের পর মাইল খেতে ফুলচাষ করেন স্থানীয় চাষিরা। দেখে মনে হবে যেন ফুলের রঙিন গালিচা পেতে রেখেছে কেউ। কি নেই এই গালিচায়? রকমারি গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, অষ্টার, গোলাপ, মরোগঝুঁটি, রজনীগন্ধার পাশাপাশি আরও কত নাম না জানা ফুল। আর এই ফুলের টানেই চলে আসে প্রচুর প্রজাপতি, মৌমাছি সহ নানান পোকামাকড়। প্রকৃতি এখানে যেন নিজের রূপ রস গন্ধ উজাড় করে দিয়েছে। শুধু চেটেপুটে এর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।
দিগন্ত বিস্তৃত জমির মধ্য দিয়ে সরু আল। এই আলপথেই চাষিদের ঘোরাফেরা, ফুলের পরিচর্যা সবটাই হয়। ফলে এই ফুলের উপত্যকায় হারিয়ে যেতে হলে আপনাকেও এই আলপথ ধরতে হবে। সেও এক অনন্য অ্যাডভেঞ্চার। প্রথমেই বলেছিলাম ক্ষীরাই হল গঞ্জগ্রাম, কারণ এখানে পৌঁছনোর রাস্তা সেরকম নেই। কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে গেলে অবশ্য আলাদা, সরাসরি পৌঁছানো যায়। তবে ট্রেনে যেতে হলে আপনাকে রেললাইন বরাবর দেড় কিলোমিটার হেঁটে পিছিয়ে আসতে হবে ক্ষীরাই স্টেশন থেকে। এটা দূরপাল্লার ট্রেনের ব্যস্ত রুট, তাই রেললাইনের ধারের সরু একফালি লাল কাঁকুড়ে মাটির পথ ধরে সাবধানে এগিয়ে যেতে হয়। প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে কাঁসাই নদীর রেলব্রিজের নীচে নেমে আসলেই ফুলের উপত্যকায় পৌঁছে যাবেন।
এ যেন এক রূপকথার জায়গা। ফুলের সমাহার ছাড়াও দেখতে পাবেন নিখাদ গ্রাম-বাংলার অপরূপ পটভূমি। চাষের ক্ষেত, পুকুরে ভেসে বেরানো হাঁসের দল, গরুর গোয়াল, লাঙল কাঁধে কৃষকের দল, মাটির ঘরবাড়ি সবই দেখা যাবে রেললাইনের অপর পাড়ে। ফলে এক বেলার জন্য ক্ষীরাই ঘুরে এসে ঠকবেন না। বরং শহরের ধুলোবালি-দূষণের থেকে অনেকটা দূরে একবুক তাজা বাতাস ও ফুলের মিস্টি ঘ্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন একরাশ স্মৃতি নিয়ে। তবে একটা কথা, ক্ষীরাইতে গিয়ে ফুল দেখুন, ছবি তুলুন কিন্তু দয়া করে ফুল ছিঁড়বেন না। কারণ এটাই ওদের জীবিকা ও জীবন ধারণের অবলম্বন।
কীভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে দুরত্ব কমবেশি ১০০ কিলোমিটার। হাওড়া স্টেশন থেকে খড়গপুর ও মেদিনীপুর লোকাল ধরে পৌঁছে যান ক্ষীরাই। পাঁশকুড়ার পরের স্টেশনই হল ক্ষীরাই। সময় লাগবে ঘন্টা দুই। স্টেশনে নেমে তিন নম্বর লাইনের পাশ দিয়ে পাঁশকুড়ার দিকে হেঁটে প্রায় আড়াই কিলোমিটার গেলেই পৌঁছে যাবেন ফুলের উপত্যকায়। আবার পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে টোটো বা অটো ভাড়া করেই যেতে পারেন কাঁসাই ব্রিজ।
إرسال تعليق
Thank You for your important feedback