লোকসভা ভোটের আগে থেকেই শাসকদল ছেড়ে বিজেপি শিবিরে যোগদানের প্রবনতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই ধারা বজায় ছিল একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগেও। তৃণমূল ছেড়ে পদ্ম শিবিরে একে একে যোগ দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, সব্যসাচী দত্ত, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈশালী ডালমিয়া, প্রবীর ঘোষাল, মিহির গোস্বামী, জিতেন্দ্র তেওয়ারি, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতো তৃণমূল বিধায়করা। তাঁদের টিকিটও দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তাঁদের প্রত্যাক্ষান করেছেন আম জনতা। রাতারাতি দল বদলে পরিবর্তনের ডাক দিলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তাঁদেরই ‘পরিবর্তন’ করলেন ভোটাররা। তবে ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে সেটা খুবই কম। জিতলেন শুধু মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী এবং মিহির গোস্বামী এবং বিশ্বজিৎ দাস। এরমধ্যে মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে লোকসভা ভোটের বহু আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে তিনি বেশ কয়েক বছর পদ্ম শিবিরের সঙ্গে রয়েছেন। বাকিরা খুব সামান্য সময়েই পদ্ম শিবিরে সময় দিতে পেরেছেন ভোটের আগে।
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আসা হেভিওয়েটদের নিজের কেন্দ্রেই টিকিট দিয়েছিল দল। আশা ছিল তাঁরা জিতে বাংলায় ‘আসল পরিবর্তন’ আনবেন। কিন্তু নিজের গড় জোমজুরে তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ ঘোষের কাছে হারলেন বিপুল ভোটে। কল্যাণবাবু পেয়েছেন, ১,৩০,৪৯৯ ভোট এবং রাজীবের ঝুলিতে এল ৮৭,৮৭৯ ভোট। রাজীব হারলেন ৪২ হাজার ৬২০ ভোটে। তৃণমূল প্রার্থী যেখানে পেয়েছেন ৫২ শতাংশ ভোট সেখানে রাজীব পেয়েছেন মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোট।
অপরদিকে বিধাননগরে প্রায় আট হাজার ভোটে তাঁর একদা সতীর্থ সুজিত বসুর কাছে হারলেন সব্যসাচী দত্ত। তিনি রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল সাংসদ এবং বিধাননগর পুরনিগমের প্রাক্তন মেয়র ছিলেন। কিন্তু দলের সঙ্গে মনমালিন্যের জেরে তৃণমূল ছেড়ে সব্যসাচী যোগ দেন বিজেপিতে। তাঁকে যথেষ্ট গুরুত্বও দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। মুকুল ঘনিষ্ঠ এই নেতার ইচ্ছাতেই দল তাঁকে বিধাননগরে টিকিট দেয়। তৃণমূলে থাকতেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক নরম-গরম ছিল সুজিত বসুর। ভোটের ময়দানে সেটা মুখোমুখী হল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কাঁটার টক্করে বাজিমাৎ করলেন সুজিতই। যেখানে তৃণমূল প্রার্থীর ঝুলিতে ৭৫,৯১২ ভোট পড়েছে সেখানে সব্যসাচী পেয়েছেন ৬৭,৯১৫ ভোট। অর্থাৎ সুজিত বসু জিতলেন ৭,৯৯৭ ভোটে। এই কেন্দ্রে অবশ্য বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ালেন কংগ্রেস প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ১২ হাজার ৬৬৪ ভোট কেটে নিয়ে সব্যসাচীর জয়ের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেন।
তৃণমূলে থাকাকালীন আসানসোল পুরসভার মেয়র তথা পাণ্ডবেশ্বরের বিদায়ী বিধায়ক ছিলেন জিতেন্দ্র তেওয়ারি। খনি এলাকায় তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। একুশের বিধানসভা ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগেই তিনি যোগ দেন বিজেপিতে। যা নিয়ে বিজেপির অন্দরেই ছিল অসন্তোষ। তবুও তাঁকে টিকিট দেয় বিজেপি। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল নতুন দলে এসে তাঁর প্রভাব খাটলোই না খনি এলাকায়। পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভায় নিজের পুরোনো আসনেই জিতেন্দ্র হারলেন ৩,৮০৩ ভোটে। তৃণমূল প্রার্থী নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পেয়েছেন ৭৩,৯২২ ভোট এবং জিতেন্দ্র পেলেন ৭০,১১৯ ভোট। এই কেন্দ্রেও জোট প্রার্থী সিপিএমের সুভাষ বারুই কাটলেন ১২ হাজার ১৯৬ ভোট।
অপরদিকে বালি বিধানসভা কেন্দ্রে সদ্য তৃণমূল ছেড়ে আসা বৈশালী ডালমিয়াও মুখ থুবড়ে পড়লেন। তৃণমূলের রানা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি হারলেন ৬,২৩৭ ভোটে। বালিতে লড়াই হল সমানে সমানে। ভোট মোটামুটি তিনভাগ হয়েছে। জয়ী প্রার্থী রানা চট্টোপাধ্যায় পেলেন ৫৩,৩৪৭ ভোট সেখানে বৈশালী পেলেন ৪৭,১১০ ভোট। বালিতে সিপিএম প্রার্থী কেটে নিলেন ২২ হাজার ৪০ ভোট। বৈশালিও ভোট ঘোষণার কিছুদিন আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বালিতে পদ্ম ফোটাতে পারলেন না।
একইভাবে হুগলির উত্তরপাড়ায় হারলেন বিজেপির প্রবীর ঘোষাল। হাওড়ার শিবপুরে হারলেন রথীন চক্রবর্তী, উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে শীলভদ্র দত্ত এবং পূর্ব বর্ধমানের কালনায় বিশ্বজিৎ কুণ্ডু হারলেন। কলকাতার ভবানীপুরে সদ্য দল বদল করে রুদ্রনীল ঘোষও বিপুল ভোটে হারলেন। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে মুখ থুবড়ে পরলেন দীপক হালদারও। একইভাবে সিঙ্গুরের হেভিওয়েট রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও হেরে গেলেন দল বদল করে। একটা ব্যাপার পরিস্কার, ক্ষমতার জন্য এই দল বদল মেনে নিতে পারেননি বাংলার রাজনীতি সচেতন মানুষ। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪ আসনের বিধানসভায় ১৪০ জন দলবদলুকে টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। যারা ২০১৭ সালের পর থেকে তৃণমূল বা সিপিএম থেকে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন।
إرسال تعليق
Thank You for your important feedback